বার্লিনালে
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩নদীমাতৃক অঞ্চলে চর কোন নতুন বিষয় নয়৷ চর হচ্ছে প্রকৃতির ভাঙাগড়ার খেলার এক নিদর্শন৷ একদিকে নদীর পাড় ভাঙে, অন্যদিকে সৃষ্টি হয় নতুন ভূমি৷ সেটা আবার নদীর বুকেই৷ ভাঙাগড়ার এই খেলাকে নিজেদের ভাগ্য হিসেবেই মেনে নেন নদী পাড়ের বাসিন্দারা৷
বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে এরকমই এক চরের সন্ধান পাওয়া গেল৷ অন্যান্য চরের সঙ্গে এই চরের খানিকটা অমিল আছে৷ এই চর গড়ে উঠেছে গঙ্গার বুকে৷ যে গঙ্গা ভারত-বাংলাদেশের কিছু অংশের সীমান্ত নির্ধারণ করে দিয়েছে৷
কিন্তু নদীর ভাঙন সীমান্তকে নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে রাখেনি৷ ভাঙনের কারণে গৃহহীন হয়েছেন অনেক মানুষ৷ একসময় তাদের বুকে আশা জাগিয়েছে একটি চর৷ গঙ্গার বুকে গড়ে ওঠা চরটিকে তারা নতুন আবাস হিসেবে বেছে নেন৷ কিন্তু জটিলতা শুরু হয় চরের মালিকানা নিয়ে৷ বাংলাদেশ-ভারত উভয়ের অধিকার রয়েছে চরের উপর৷ তাই নদীর বুকে জেগে ওঠা চরের মাঝখান থেকে প্রতীকী সীমান্ত দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়৷ দুই দিকে যার পাহারায় নিয়োজিত ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা৷
বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের ফোরাম বিভাগে প্রদর্শন করা হয়েছে বাংলা তথ্যচিত্র ‘মধ্যিখানে চর'৷ কোলকাতাভিত্তিক পরিচালক সৌরভ ষড়ঙ্গী এই ছবিটির নির্মাতা৷ মূলত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভারতের অংশে তথ্যচিত্রটি ধারণ করেছেন তিনি৷ চরের বাসিন্দাদের নিত্যদিনের সুখ-দুঃখের গল্প তিনি তুলে ধরেছেন এতে৷ পাশাপাশি সীমান্তভিত্তিক গরু, চাল, ফেনসিডিল চোরাচালানের বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে তথ্যচিত্রে৷ যদিও সীমান্তের এসব বিষয় তাঁর তথ্যচিত্রের মূল লক্ষ্য নয়৷ তথাপি সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনের অংশ এগুলো৷
বার্লিনের পস্টডামাপ্লাট্সের সিনেমেক্সে শনিবার রাত দশটায় মধ্যিখানে চরের একটি প্রদর্শনী হয়৷ বলাবাহুল্য, পুরো হল ভর্তি ছিল দর্শকে৷ প্রদর্শনীর পর পরিচালক সৌরভ ষড়ঙ্গীকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন দর্শকরা৷ ছবিতে তিনি দেখিয়েছেন ফারাক্কা বাঁধকে৷ এই বাঁধ কেন তৈরি করা হয়েছিল? এক দর্শক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন সৌরভকে৷ যদিও তিনি এর উত্তর দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি নন, তবুও সৌরভ চেষ্টা করেন জবাব দিতে৷ ব্যক্তিগতভাবে সৌরভ মনে করেন না, যে এই বাঁধ যেখানে তৈরি করা হয়েছে, সেটি আসলে সঠিক জায়গা৷ পাশাপাশি তিনি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মাঝে ফারাক্কার কুপ্রভাবের কথা স্বীকার করলেন৷ জানালেন, পানি বণ্টনের যে চুক্তি দু'দেশের রাজনৈতিক মহল করেছে, সেটা আসলে বাস্তবে ঠিকভাবে কাজ করে না৷ কেননা, বাঁধের অনেক গেট অকেজ৷
একইভাবে শুধু ভারতের অংশে দৃশ্যায়নের জন্যও প্রশ্নের মুখে পড়েন সৌরভ৷ তিনি তখন এই তথ্যচিত্রকে কোন প্রতিবেদন হিসেবে না দেখার অনুরোধ জানান৷ তাঁর কথা হচ্ছে, সীমান্তের উভয় পাশের গল্প একই রকম৷ যেকারণে তিনি দ্বিতীয় পাশটা আর তুলে ধরতে চাননি৷ কেননা, এটা কোন সীমান্তভিত্তিক প্রতিবেদন নয়, এটা সেখানকার জনজীবনের বাস্তব চিত্র৷
সৌরভের তথ্যচিত্রটির মূল নায়ক এক কিশোর৷ নাম রুবেল৷ এই রুবেল দারিদ্র্যের চাপে ১৬ বছর বয়সে লেখাপড়া বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে৷ সিনেমেক্সের এক দর্শক রুবেলের এই সিদ্ধান্তে হতাশ হন৷ প্রদর্শনী শেষে তাই তিনি অনুরোধ করেন সৌরভকে, যাতে রুবেলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়৷ তিনি চান রুবেল আবারো বই হাতে তুলে নিক৷ আর এজন্য সব ধরনের সহায়তা করতে চান জার্মান এই সেবিকা৷
সামগ্রিকভাবে সৌরভের ‘মধ্যিখানে চর' ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে৷ বিশেষ করে মধ্যরাতে হলভর্তি দর্শক দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পরিচালক নিজেও৷ ছোট্ট ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে রাতের পর রাত চরে কাটানোটা সার্থক, সেটা স্বীকার করেন সৌরভ৷