বাড়িভাড়া আইন
১ আগস্ট ২০১৫বলার বেলায় সবাই হয়ত বলবেন, ‘‘আমি আইন মানতে চাই৷'' সবাই যদি আইন মানতে এত উৎসাহী তাহলে বাড়িভাড়া নিয়ে এত অসন্তোষ কেন? এবং অসন্তোষটা শুধু কথায় কেন? ‘কাজে' কেন নেই?
আয়তন, জনসংখ্যা, শিক্ষার হার, আইনের শাসন বা সুশাসন, গণতন্ত্র, প্রবৃদ্ধি, মানবাধিকার – কোনো মানদণ্ডেই বাংলাদেশ জার্মানির সমতূল্য তো দূরের কথা, কাছাকাছি আসার মতোও নয়৷ তবে বাড়িভাড়া নিয়ে যদি কথা হয়, দেখা যাবে একটি বিষয়ে বাংলাদেশও জার্মানির প্রায় সমান৷ আইন৷ হ্যাঁ, বাড়িভাড়া নিয়ে বাংলাদেশে যে আইন রয়েছে তা জার্মানির আইনের চেয়ে কোনো দিক থেকেই খুব খারাপ নয়৷
জার্মানিতেও বাড়িওয়ালাদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ানোর প্রবণতা ছিল৷ সেই প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করতেই এসেছে নতুন আইন৷ সেই আইন এখন পুরোনো, তবে কার্যকর৷ ভাড়াটেরা নিজের স্বার্থেই সেটা মানছেন৷ বাড়িওয়ালারা তো মানতে বাধ্য৷ কোনো বাড়িওয়ালা যদি সব শর্ত উল্লেখ করে একটা চুক্তিপত্র তৈরি না করেন এবং সেই চুক্তিপত্রে ভাড়াটের স্বাক্ষর নিয়ে চুক্তি চূড়ান্ত না করেন, তাহলে বাড়ি ভাড়া দেয়াই অবৈধ৷ অবৈধ কাজ করলে ‘শাস্তি' এ দেশে হবেই৷ শাস্তির ভয়েই কোনো বাড়িওয়ালা (সে তিনি যত ক্ষমতাধরই হন না কেন), লিখিত চুক্তিপত্র ছাড়া বাড়ি ভাড়াই দেন না, দেবেন না৷
ভাড়া কত হবে, বিদ্যুৎ বিল বা পানির বিল কী হারে, কীভাবে পরিশোধ করতে হবে, ময়লা ফেলার খরচ কত করে দিতে হবে – সব ওই চুক্তিপত্রে খুব স্পষ্ট করে লেখা থাকে৷ ভাড়াটে কোনোভাবে নিয়ম লঙঘন করলে তাঁকে শায়েস্তা করার আইন আছে, বাড়িওয়ালাকে ‘সোজা' রাখার ব্যবস্থাও আছে সেই আইনে৷ এ দেশে ভিনদেশি মানুষ অনেক৷ অনেকেরই জার্মান ভাষা এবং আইনের খুঁটিনাটি জানা নেই৷ এই দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে বাড়িওয়ালা কোনো ভাড়াটেকে ঠকাবেন? সম্ভব নয়৷ ভাড়াটেদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ সংগঠন আছে৷ সেই সংগঠনে আছে আইনজীবী৷ বাৎসরিক একটা ফি দিয়ে সেই সংগঠনের সদস্য হয়ে থাকলে ভাড়াটে যখনই বিপদে পড়বেন, তখনই উকিল নিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াবে সেই সংগঠন৷ বাড়িওয়ালার পালানোর পথ সেখানেই বন্ধ৷
বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বাংলাদেশের আইনও খুব ভালো লিখিত চুক্তিপত্রের উল্লেখ সে আইনেও আছে৷ বাড়িওয়ালা যাতে অযৌক্তিভাবে বেশি ভাড়া না নেন, যাতে যখন-তখন ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়াতে না পারেন, বাড়ালে যাতে প্রতিরোধ বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায় – এমন ব্যবস্থাও করা আছে আইনে৷ কিন্তু....
ওই ‘কিন্তু'-টা হলো আইনের প্রয়োগ এবং কার্যকারিতা৷ সবাই নিশ্চয়ই বলবেন, ‘‘বাংলাদেশে আইনের প্রয়োগ নেই, কার্যকর হয় না৷'' আইনকে কার্যকর করার চেষ্টা কি আছে? ‘শিক্ষিত', ‘সচেতন' ভাড়াটেরাও সমস্যায় পড়লে আইনের খোঁজ নেন, আইনের দ্বারস্থ হন? বলার মতো উদাহরণ আছে আপনাদের জানা?
জার্মানিতে হাতে হাতে ভাড়া দেয়ার নিয়ম নেই৷ বাড়িওয়ালা, ভাড়াটে সবারই ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে৷ ভাড়ার টাকা বাড়িওয়ালার অ্যাকাউন্টেই জমা করতে হয়৷ এ নিয়ে কারোই কোনো আপত্তি নেই৷ অথচ বাংলাদেশে ব্যাংকে ভাড়ার টাকা জমা দেয়ার ব্যাপারেও দু পক্ষেরই ঘোর আপত্তি৷ সরকার আইন করে আন্দোলনের মুখে পড়েছে ৷ জার্মানিতে আইনের প্রতি সবার এমন অশ্রদ্ধা বা অনাস্থা অকল্পনীয়৷
সম্প্রতি সব বাড়িওয়ালা যাতে এলাকা অনুযায়ী ভাড়া স্থির করেন তা দেখার জন্য কমিশন গঠনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার৷ কমিশনও না হয় হলো৷ তাতে কি পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হবে? ভাড়া নির্ধারণে বাড়িওয়ালাদের স্বেচ্ছাচারিতা কমবে? আশাবাদী হওয়া কঠিন৷ আইন মানার প্রবণতাই যে আমাদের প্রায় ‘নেই' বলার মতো৷ অতি নগণ্য ব্যতিক্রম বাদে আইন কার্যকর বা চর্চা করার জন্য সামান্যতম কষ্ট স্বীকারের মানসিকতারও যে বড় অভাব!