ধর্মের রাজনীতির ‘প্রবর্তক’ ও ‘প্রতিপালক’
১১ জুলাই ২০১৬শুধু আওয়ামী লীগ নয়, প্রথম সারির বাম দলগুলোও কৌশলে ধর্মের রাজনীতির সঙ্গে আপোশ করেই পথ চলছে৷ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের দুই মন্ত্রীকে তো হজে যাওয়ার আগে সে খবরটি সংবাদমাধ্যমকে ঘটা করে জানিয়ে যেতেও দেখা গেছে৷ তাদেরও যে প্রচার দরকার! দেখানো দরকার যে তাঁরাও ‘ধার্মিক'৷ নিজেকে ধার্মিক হিসেবে জাহির করায় তো আজকাল অনেক ‘সুবিধা'৷ আর তাঁরা তো বাম দলের নেতা৷ সবাই তাঁদের প্রগতিশীল ভাবেন৷ ‘ধার্মিক' ইমেজ তৈরি করা গেলে প্রতিক্রিয়াশীলরাও ‘নাস্তিক' তালিকায় তাঁদের রাখবে না৷ সুতরাং তখন দু'দিক থেকেই নিরাপদ৷
ধর্মকে এভাবে নিজের বা দলের সুবিধার জন্য ব্যবহার করাটাও এক ধরনের অপরাজনীতি৷
ভালো কাজ তো স্বার্থচিন্তা ছাড়াই করা ভালো৷ ধর্মেও আছে এমন কথা৷ ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, ‘‘তুমি এমনভাবে অন্যের উপকার করবে যাতে ডান হাত দিয়ে উপকার করলে বাম হাতও জানতে না পারে৷''
অথচ ধর্মের রাজনীতিটা হয়ই প্রচারের জন্য৷ ধর্মের প্রচার নয়, ধর্মের নামে নিজের বা দলের স্বার্থে উদ্দেশ্যমূলক প্রচার৷ সেক্ষেত্রে দলের নামে ‘ইসলাম' শব্দটা থাকলে অনেক মানুষের মনে জায়গা করে নেয়া, মানুষকে ধোঁকা দেয়াটাও সহজ৷ সরল, ধর্মপ্রাণ মানুষদের কেউ কেউ ভেবে নিতে পারেন ‘‘দলটির নামের সঙ্গে ‘ইসলাম' আছে, মুখেও তারা ইসলামের কথা বলছে, সুতরাং তারা নিশ্চয়ই ইসলামের রক্ষক৷''
অথচ দলের নামে ‘ইসলামী' শব্দটি থাকলেও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী কী কী অপকর্ম করেছিল তা তো সবাই জানেন৷ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ পরিবার আর ধর্ষিতা নারীর স্মৃতিতে সেসব আছে, ইতিহাসের পাতায়ও তা লেখা আছে৷
এমনিতে উপমহাদেশের রাজনীতি কখনোই একেবারে ধর্মের প্রভাবমুক্ত ছিল না৷ বিশেষ করে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পর থেকে তো নয়ই৷ ১৯৪৯ সালে আজকের আওয়ামী লীগও তাই আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' নামে৷ তারপর দলটির নাম হয়ে যায় ‘পাকিস্তান আওয়ামী লীগ'৷ বাঙালি জাতীয়তাবাদই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে দলটির কাছে৷ সত্তরের নির্বাচনে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও এই ভূখণ্ডের আপামর মানুষ তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষেই থেকেছে৷
সেই আওয়ামী লীগই কেন রাজনৈতিক আকাঙ্খা পূরণে ধর্মের ব্যবহারকে মোক্ষম অস্ত্র মনে করছে? যে দেশের জন্মই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে, সেই দেশই বা কিভাবে আবার উল্টো হাঁটে?
কারণটা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে জানতে চাইলে তিনি কী বলবেন তা কিছুটা অনুমান করতে পারি৷ তিনি হয়ত বলবেন, ‘‘এ জন্য বিএনপি আর জামায়াতই দায়ী৷ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কখনোই ধর্মের রাজনীতি করে না৷''
বিএনপি সভানেত্রী খালেদা জিয়াও নিশ্চয়ই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়ানোয় তার দলের বিশেষ ভূমিকার কথা অস্বীকারই করবেন৷ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তিনিও নিশ্চয়ই জামায়াতকে গোপন করে অভিযোগের আঙুলটা তাক করবেন আওয়ামী লীগের দিকে৷
কিন্তু বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির কথা হবে, অথচ জামায়াত প্রসঙ্গে চুপ থাকবেন, তা কি হয়? আম ছাড়া কি আমসত্ব হয় নাকি?
বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জামায়াতকে ফিরিয়েছিল বিএনপি
জামায়াতে ইসলামীর ‘পুনর্জন্ম' না হলে বাংলাদেশে ধর্মের রাজনীতি এভাবে বিকশিত হতো না৷ স্বাধীন দেশে ধর্মের অপরাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল৷ যুদ্ধাপরাধে ব্যাপকভাবে জড়িত জামায়াতে ইসলামীও তখন নিষিদ্ধ ছিল৷
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এবং নারী-শিশুসহ তার পরিবারের প্রায় সবাইকে হত্যা করার পর ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অনেক কিছুই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোশকতায় ফিরিয়ে আনা হয়৷ জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জামায়াতে ইসলামীর ওপর থেকেও নিষেধাজ্ঞাটা তুলে নেয়া হয়৷ পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা জামায়াত নেতারা একে একে ফিরেও আসে পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের পরে৷
জিয়াউর রহমান বাকশাল ‘নাকচ' করে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা ফিরিয়ে এনেছিলেন – এ কথা খুব গর্ব করে বলে বিএনপি৷ কিন্তু একটা কথা বিএনপির সব নেতাই চেপে যান৷ বিএনপির কোনো নেতা বা সমর্থক কখনোই স্মরণ করতে চায় না যে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জামায়াতে ইসলামীকেও রাজনীতিতে ফিরিয়েছিলেন ‘শহিদ প্রেসিডেন্ট' জিয়াউর রহমান৷
টসটসে পাকা আম খুব ভালো৷ ফরমালিনযুক্ত হলে সেই আমই কিন্তু ভয়ঙ্কর৷ জামায়াত ফেরার পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিও সেই নিয়মে ‘ফরমালিনযুক্ত' হয়েছে৷
ভারতবিদ্বেষের নামে ‘হিন্দুবিদ্বেষ'
একাত্তরে প্রকৃত বন্ধুরাষ্ট্রের মতোই পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত৷ কিন্তু তার পরে অনেকভাবেই তারা বন্ধুত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে৷ এ প্রসঙ্গে ফারাক্কা বাঁধ, তিনবিঘা করিডোর, শিলিগুড়ি করিডোর, অর্থনৈতিক ট্রানজিট, সমুদ্র অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে বিরোধ, সীমান্তে বিএসএফ-এর বাংলাদেশি নাগরিক হত্যাসহ অনেক বিষয়ই উল্লেখের দাবি রাখে৷ কূটনীতিক উদ্যোগের মাধ্যমে এ সবের অনেকগুলোরই নিষ্পত্তি বা সমাধান সম্ভব৷ কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি নিশ্চয়ই হয়েছে৷ তবে অনেক বিষয়ে, বিশেষ করে বিএসএফ-এর নির্বিচারে বাংলাদেশি হত্যার বিষয়ে জনমনে অসন্তোষ আছে৷ ক্ষোভ আছে৷
দু'দেশের সম্পর্কে চিড় ধরানোর আশঙ্কা জাগানো সব সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের সব সরকারই কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছে৷ কিন্তু বিএনপি কূটনৈতিকভাবে ভারতের সঙ্গে যেমন সম্পর্কই প্রত্যাশা করুক, খোলা ময়দানের রাজনীতিতে সবসময় ভীষণ নোংরাভাবে ভারতবিদ্বেষই ছড়িয়েছে৷ বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনামলের শেষদিকে সার্ক প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখে আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করেছিলেন৷ কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া দলের সভানেত্রী হওয়ার পর বিএনপি কোমর বেঁধে শুরু করে ভারতবিদ্বেষ ছড়ানোর রাজনীতি৷ অনেক ক্ষেত্রেই তা শিষ্টাচারের সীমা ছাড়িয়েছে৷ অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্বেষটা দেশ ছাড়িয়ে হয়ে গেছে সম্প্রদায় বিরোধী৷ ভোট এলে স্বয়ং খালেদা জিয়াকেও অনেকবার বলতে শোনা গেছে, ‘‘আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে দেশ বিক্রি হয়ে যাবে, ঘরে ঘরে উলুধ্বনি শোনা যাবে৷'' দেশ বিক্রি হয় না৷ বিক্রি হয়নি৷ মাঝখান থেকে সাম্প্রদায়িকতা ঠিকই বেড়েছে৷
আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে ভারতবিরোধিতায় এত বাড়াবাড়ি কেন? ‘উলুধ্বনি শোনা যাবে' বা এই জাতীয় বক্তব্যের মাধ্যমে সমর্থকদের কী ছড়াতে চায় বিএনপি? উগ্রতা নয়? সাম্প্রদায়িকতা নয়? অন্য ধর্ম বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে বিষোদগার বা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো নিঃসন্দেহে ধর্মীয় রাজনীতির নিকৃষ্ট উদাহরণ৷
বিএনপির পথ ধরেই ‘রাষ্ট্রধর্ম' করেছিলেন এরশাদ
জামায়াতকে ফিরিয়ে বিএনপি রাজনীতিতে ‘ফরমালিন' মেশালেও রাজনীতিকে ‘ফরমালিনমুক্ত' করার উদ্যোগ কেউই আর নেয়নি৷ বরং আরো নতুন নতুন উপায়ে ‘ফরমালিন' মিশিয়ে সর্বস্তরের জনগণের মাঝে উগ্রতা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টাই লাগাতার হয়ে এসেছে৷ সংবিধানে পরিবর্তন এসেছে৷ সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ধর্ম নিয়ে রাজনীতির খেলায় সবচেয়ে মোক্ষম চালটা চেলেছিলেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে৷ এরশাদের পতনের ২৬ বছর পর সংবিধান এবং সম্ভবত জনমনেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আরো জেঁকে বসেছে৷
জামায়াতকে আরো ওপরে তুলেছে বিএনপি
স্বাধীনতার পরে যে দলটি নিষিদ্ধ ছিল বিএনপির বিশেষ কৃপায় সেই জামায়াত এক সময় জাতীয় সংসদেও ঢুকে পড়ে৷ ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত তো বিএনপির সহযোগী শক্তি হিসেবে মন্ত্রী পরিষদেও ঢোকে৷ আলবদর নেতা, যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামী তখনই কৃষি ও শিল্পমন্ত্রী হন৷
বিএনপি কখনো যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগও নেয়নি
আওয়ামী লীগ নিজামী বা অন্য কোনো যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাকে মন্ত্রীত্ব দেয়নি৷ তবে ধর্মের রাজনীতি সব রকমভাবেই তারা করেছে, করছে৷ আওয়ামী লীগ আর বিএনপির খুব বড় পার্থক্য শুধু একটি জায়গায়৷ আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে আর বিএনপি এই বিচার শুরুর উদ্যোগও কখনো নেয়নি৷
জামায়াতের ‘চুমু' পেয়েছে বিএনপি
ধর্মের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ অনেক জায়গাতেই মেধাহীন, আদর্শহীনের মতো বিএনপিকে অনুসরণ করেছে৷ হেফাজতের সঙ্গে অলিখিত বোঝাপড়াটাও তার একটি প্রমাণ৷ যে হেফাজতকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টায় ব্যবহার করেছিল বিএনপি, সেই হেফাজত এখন অনেকাংশেই আওয়ামী লীগের অনুগত৷ এছাড়া ধর্মের রাজনীতিতে প্রায় হেফাজতের সমতুল ‘ওলামা লীগ'ও আছে আওয়ামী লীগের৷
এতকিছুর পরও ধর্মীয় রাজনীতিতে একটা জায়গায় বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে পরিষ্কার ব্যবধানে এগিয়ে৷ আওয়ামী লীগ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বহুবারই বলেছে, জামায়াতে ইসলামীকে তারা আবার নিষিদ্ধ করবে৷ এখনো জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করলেও দলটির অনেক নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠিকই করছে আওয়ামী লীগ৷ অন্যদিকে বিএনপি শত সমালোচনার পরও জামায়াতকে ছাড়বে না বলেই যেন পণ করেছে৷ কয়েক দিন আগে সে কারণেই হয়ত বিএনপির প্রতি বিশেষ ভঙ্গিতে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছে জামায়াত৷ এক ইফতার পার্টিতে বিএনপি নেতাদের ধরে ধরে কপালে চুমু খেয়েছেন জামায়াতের এক নেতা৷
আওয়ামী লীগের এত আপোশ আর বিএনপিকে জামায়াতের চুম্বনে ধন্য হতে দেখার পর বাংলাদেশে ধর্মের অপরাজনীতি বন্ধের কি আর কোনো সম্ভাবনা থাকতে পারে?
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷