বিচার আদালতে দণ্ডিতেরা নির্বাচনের অযোগ্য: হাইকোর্ট
২৩ অক্টোবর ২০২৩ওই রায়ে আরো বলা হয়েছে আপিল বিভাগে মামলা চলাকালে বিচারিক আদালতের দণ্ড স্থগিত করে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কোনো সুযোগ নাই৷
অবশ্য এ রায় নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে৷ বিতর্ক হচ্ছে বিচারিক আদালতের রায় চূড়ান্ত কী না এবং সামনের নির্বাচনে এই রায়ে কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷ আইনজীবীরা বলছেন, এর আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের এক মামলায় আপিল থাকা অবস্থায় নির্বাচনের সুযোগ আছে বলে আপিল বিভাগের রায় আছে৷ এরকম আরো কয়েকজন আপিল পর্যায়ে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছেন৷
দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত বিএনপির পাঁচ নেতা আমানউল্লাহ আমান, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, বিএনপির সাবেক এমপি ওয়াদুদ ভূঁইয়া, মো. মশিউর রহমান এবং মো. আবদুল ওহাব ২০১৮ সালে হাইকোর্টে দণ্ড স্থগিত চেয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পেতে আবেদন করেছিলেন৷ কিন্তু ওই বছরের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার এবং বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের বেঞ্চ তা খারিজ করে দেন৷ তাদের সেই আদেশের পূর্ণাঙ্গ রায় রোববার প্রকাশিত হয়েছে৷
এই মামলায় দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, নৈতিক স্খলনের মামলায় কারো দুই বছর বা তার বেশি সাজা হলে সাংবিধানিকভাবে তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হন৷ সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নৈতিক স্খলনজনিত কারণে কোনো ব্যক্তি দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে এবং মুক্তি লাভের পর পাঁচ বছর সময় অতিবাহিত না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবেন না৷ এর ব্যাখ্যা দিয়ে আদালত রায়ে বলেছেন, সাজা কখনো স্থগিত হয় না৷ দুর্নীতি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত কিছু ব্যক্তি বিচারাধীন আপিলে একটি দরখাস্ত দিয়েছেন সাজা স্থগিতের জন্য৷ কারণ স্থগিত না হলে তারা সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না৷ হাইকোর্ট বেঞ্চটির মতে, আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দণ্ড বহাল থাকবে কাজেই সাজা কখনো স্থগিত হয় না৷”
সাজা স্থগিত থাকার বিষয়টি হলফনামায় উল্লেখ করে প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনকে ভুল মেসেজ দিয়ে বৈধতার সুযোগ অনেক সময় নেয়ার চেষ্টা করে৷ এই রায়ের ফলে সেই সুযোগ বন্ধ হলো বলে জানান তিনি৷
খুরশীদ আলম খান সোমবার ডয়চে ভেলেকে বলেন,"শুধু তাই নয়, কেউ যদি হলফনামায় সাজার বিষয় গোপন করে নির্বাচিত হন আর যদি সেটা প্রকাশ হয় তাহলে সেদিন থেকেই তার সদস্যপদ বাতিল হবে৷ আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়াপর পরও কেউ যদি দুই বছরের বেশি দণ্ডিত হন তাহলে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে৷ কোনো ক্ষেত্রেই শুধু আপিল করে টিকে থাকার সুযোগ নেই৷ আপিল আদালতে দণ্ড বাতিল না হওয়া পর্যন্ত বিচারিক আদালতের দণ্ডই এই ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে৷”
অন্যদিকে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল দাবি করেন এই সময়ে এই ধরনের একটি রায় প্রকাশের পিছনে উদ্দেশ্য আছে৷ তিনি বলেন, "আইনের নীতি হল আপিল ইজ দ্য কন্টিনিউয়েশন অব জাজমেন্ট৷ এই রায়টি এখন যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলছে তার গলা টিপে ধরার জন্য৷ এরইমধ্যে আমাদের অনেক নেতাকে দণ্ড দেয়া হয়েছে৷ সামনে আরও অনেকে দণ্ডের মুখে পড়বেন৷ নির্বাচনে অযোগ্য করার এটা একটা কৌশল৷”
তার কথা,"অতীতে এইচ এম এরশাদ এবং মহিউদ্দিন খান আলমগীরসহ আরো অনেকে দণ্ড নিয়ে নির্বাচন করেছেন৷ তাদের ব্যাপারে তো উচ্চ আদালত নির্বাচনের সুযোগ দিয়েছে৷ তাহলে বিএনপি নেতাদের ক্ষেত্রে এই রায় কেন?”
তিনি আরো বলেন,"বিচারিক আদালতের রায়ই যদি চূড়ান্ত হতো তাহলে তো আর আপিল আদালতের কোনো প্রয়োজন থাকত না৷ আর কাউকে বিচারিক আদালক মৃত্যুদণ্ড দিলেই তা কার্যকর হয়ে যেত৷ কিন্তু তা তো হয় না৷ চূড়ান্ত আদালত যে রায় দেয় সেটাই চূড়ান্ত রায়৷ কারণ অনেকে তো আপিলে খালাস পেয়ে যান৷”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন,"এরশাদের মামলায় সংবিধানের ওই ধারার ব্যাপারে আপিল বিভাগ প্রিন্সিপাল সেটেল করেছেন৷ আপিল বিভাগ বলেছেন, আপিল ইজ দ্য কন্টিনিউশেন অব ট্রায়াল৷ ফলে আপিল চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হওয়ার আগে বলা যাবে না যে সাজা হয়েছে৷ সাজা বাতিল হতে পারে, বহালও হতে পারে৷ কাউকে বিচারিক আদালতের দণ্ডের কারণে নির্বাচনের অযোগ্য করা হলো৷ কিন্তু আপিলে তার দণ্ড বাতিল হলো৷ তাহলে তো তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো৷ এই কারণেই আপিল বিভাগ এরশাদের মামলায় আপিল আদালতের রায়কেই চূড়ান্ত বলেছেন৷ তার আগে নয়৷ এরশাদ নির্বাচনের সুযোগ পেয়েছেন৷ আর কেউ আপিল না করলে সেটা আলাদা কথা৷”
তিনি মনে করেন,"হাইকোর্টের যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেয়েছে এটা আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷ আর কোনো রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে আপিল বিভাগের রায়ই প্রযোজ্য হবে৷”
তার কথা,"এই রায়ের প্রেক্ষাপট এবং সময় দেখলে এটা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক উঠতেই পারে৷ এই রায়ে বিএনপি নেতারাই এখন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷ এটা নিয়ে তো মানুষ কথা বলবে৷ যদি রায়ে মনে হয় বিএনপি বা একটি অংশের জন্য এটা ক্ষতির কারণ হবে, আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধা হবে, তাহলে তো এটা বিচার বিভাগের দুর্বলতাই প্রকাশ করে৷”