বিচারকের বাণী কেন আমাদের মুখে?
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০গেল এক সপ্তাহ ধরে যুগলীগ নেত্রী পাপিয়া তথা পিউর কথা মুখে মুখে৷ বাংলাদেশিদের সামাজিক গণমাধ্যমও পাপিয়াময়৷ পাপিয়ার কীর্তি রুপালি পর্দাকেও হার মানায়- এমন সব হেডলাইনে ভরপুর বিভিন্ন গণমাধ্যম৷ এই নারী কত টাকা হোটেলের বিল দিয়েছেন, তার সঙ্গে নগদ কত টাকা রয়েছে, তার ক্যাডার বাহিনী, অসহায় তরুণীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করা, সেই নারীদের সঙ্গে অনেক ব্যক্তির অশ্লীল ভিডিও ধারণ, পরে ভিডিও দেখিয়ে ব্যক্তিদের ব্লাকমেল করা ইত্যাদি নানা গল্পে মশগুল প্রথম সারির মিডিয়াগুলোও৷ আর এসব তথ্যের সূত্র কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী৷
এতে কোনো সন্দেহ নেই, পাপিয়ার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, বিশেষ করে নারীদের পিটিয়ে তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয়া- খুবই গুরুতর অভিযোগ৷ এসবের অনেক ভিডিও আছে তাও হয়ত সত্য৷ কিন্তু অন্য অভিযোগগুলোর দিকে তাকান৷ অঢেল অর্থ? তো অনেকেরই আছে৷ অনেকেই খুব অল্প সময়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন৷ জাল টাকা মিলেছে৷ এই অভিযোগও গুরুতর৷ কিন্তু নতুন নয়৷ তদবির করা, চাকরি দেবার নাম করে টাকা নেয়া, গুন্ডাবাহিনী পালা- কোনোটা কি নতুন শোনাচ্ছে? মজার ব্যাপার হল, গর্ত খুড়তে গেলে এমন অভিযোগ বা সমান গুরুতর অন্য অনেক অভিযোগ হয়ত অনেকের বিরুদ্ধে পাওয়া যাবে৷
তো এখনো পর্যন্ত এগুলো সবই অভিযোগ৷ কিন্তু সম্রাট থেকে শুরু করে পাপিয়া, সব ঘটনাতেই তারা চুড়ান্ত দোষী সাব্যস্ত হবার আগেই দোষী হয়ে যান! আমাদের অধিকাংশ মিডিয়া শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া তথ্যগুলোই প্রকাশ করে এসব ক্ষেত্রে৷ দু'একটি মিডিয়ায় পাপিয়া বা তার স্বামীর আইনজীবীরা কী বলছেন, তা প্রকাশিত হয়েছে৷
এটা ঠিক যে, গণমাধ্যম কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে৷ যেমন, পাপিয়া বা সম্রাটকে যারা আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে এমন বানিয়েছেন তারা কারা? নরসিংদী আওয়ামী লীগের লোকজন তো সরাসরিই বললেন যে, পাপিয়াকে পদ দেয়া হয়েছে ‘চাপ'-এর কারণে৷ তো সেই চাপ দলের মধ্যে কারা দেন, তা কি খুঁজে দেখবে আওয়ামী লীগ? খুঁজে দেখলে প্রকাশ করবে? কিংবা ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই পাপিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে৷ তো পাপিয়া কতটা ক্ষমতাবান যে স্বয়ং সরকারপ্রধানকে নির্দেশ দিতে হয়! এই ক্ষমতার উৎস কী? তো এসব প্রশ্ন খুবই যুক্তিসংগত৷
যখন এমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা ঘটনা উন্মোচিত হয়, তখন গণমাধ্যম সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা ঠিক৷ এমন কাউকে গ্রেফতার করা হলে, তা পত্রপত্রিকা-টিভিতে ঢালাওভাবে প্রকাশিত করা হবে, তাও ঠিক৷ কিন্তু সেখানে যেভাবে অভিযুক্তের চরিত্র হনন করা হয়, তা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের৷ কিংবা মিডিয়াগুলো যতটা পাপিয়া-পাপিয়া করছে, ততটা কি তার স্বামী মফিজুরের নাম নিচ্ছে? নিচ্ছে না৷ কারণ একজন নারীর চরিত্র হনন করা হয়ত বেশি ‘গুরুত্বপূর্ণ' আমাদের কাছে৷ অথচ মফিজুরও একই অভিযোগে অভিযুক্ত৷ এ সবকিছুর মধ্য দিয়ে সাধারণভাবে আমাদের একটা সামাজিক চরিত্র ফুটে ওঠে, যা মোটেই সুখকর নয়৷ আমার মনে হয়, আমাদের আরো দায়িত্বশীল আচরণ করার প্রয়োজন আছে৷
আরো একটি ব্যাপার আছে৷ এ ধরনের ঘটনাগুলোতে সবসময়ই এক বা একাধিক চরিত্রকে নিয়ে খুব মাতামাতি শুরু হয়৷ ঘটনায় আরো যেসব কুশীলব থাকেন, তারা ঐ কেন্দ্রীয় চরিত্রের আড়ালে পড়ে যান৷ শুধু অন্য কুশীলবরাই নন, মূল ঘটনার চেয়েই ব্যক্তি বড় হয়ে ওঠেন৷ তাই মানুষ চরিত্রকেই মনে রাখেন৷ কৌশলগতভাবেই ঘটনা খুব দ্রুত ভুলে যান৷
এবার আসি আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের প্রসঙ্গে৷ তদন্তাধীন ঘটনায় তারা যেভাবে ‘তথ্য' দিতে থাকেন, তা পৃথিবীর আর কোথাও হয় বলে আমার জানা নেই, অন্তত জার্মানিতে দেখা যায়না৷ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় আনুষ্ঠানিক প্রেস ব্রিফিং হতে পারে, হয়ও৷ বড় দুর্ঘটনার সময় আমরা দায়িত্বশীল আচরণ দেখেছি এর আগে৷ কিন্তু পাপিয়ার ঘটনায়, পত্রপত্রিকাগুলো জুড়ে যেভাবে শুধুই .ব্যাবের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে খবর প্রকাশ করা হচ্ছে, তাতে বিচারের আগেই বিচারের বাণী শোনানোর মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷ এ পরিস্থিতি কাম্য নয়৷
জার্মানিতে পত্রপত্রিকাগুলো ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী অপরাধীদের পরিচয় প্রকাশের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলে৷ যেমন, অপরাধীর পরিচয় তদন্তের সময় যতটা সম্ভব গোপন রাখা৷ অনেক গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রেও অভিযুক্তের পারিবারিক নামটি পুরো প্রকাশ করা হয় না৷ তার গোষ্ঠীগত পরিচয়কে খুব প্রয়োজন না পড়লে বড় করে তুলে ধরা হয় না৷ এসব কারণে তাদের স্থানীয়দের গালিও খেতে হয় কখনো সখনো৷ বিশেষ করে দক্ষিণপন্থীদের অভিযোগ, জার্মানির মিডিয়া অভিবাসী অপরাধীদের পরিচয় ঠিকঠাক প্রকাশ করে না৷ সে যাই হোক, একটা নৈতিক অবস্থান নিয়ে থাকে মিডিয়া ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী৷ কারণ, তারা বিশ্বাস করে বিচারের বাণী বিচারকের কাছ থেকেই আসুক৷ তাতে সুরক্ষিত থাকে গণতন্ত্র৷