বিচারহীনতা নারীকে নিরাপত্তাহীন করছে
২৫ মে ২০১৫‘এর মধ্য দিয়েই তৈরি হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি', বলছেন মানবাধিকার ও নারী আন্দোলনের কর্মীরা৷
বাংলাদেশের বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ৬৬০ জন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ অথচ কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ তদন্ত কাজই শেষ করতে পারেনি৷ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিচারহীনতার কারণেই আজকের এই পরিস্থিতি৷ তাহলে আমাদের দেশে নারীর কতটা ক্ষমতায়ন হয়েছে, তা ভেবে দেখার সময় কি এসেছে?''
সর্বশেষ গত ২১শে মে সন্ধ্যায় রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় রাস্তা থেকে এক গারো তরুণীকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে পাঁচজন দুর্বৃত্ত গণধর্ষণ করে৷ পরে রাতেই তাঁকে উত্তরা এলাকায় ফেলে যায় তারা৷ এই তরুণী বাদি হয়ে থানায় মামলা করলেও পুলিশ সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি৷ এ ঘটনার দিন ১৫ আগে নারায়ণগঞ্জে একজন গার্মেন্টস শ্রমিককে বাসের মধ্যে ধর্ষণ করে চালক ও হেল্পার৷ ঐ ঘটনায় পুলিশ অবশ্য তাদের গ্রেপ্তার করেছে ইতিমধ্যেই৷
তারও আগে ১৪ই এপ্রিল ১লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকজন নারী লাঞ্ছনার শিকার হন৷ একই দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আদিবাসী শিক্ষার্থীকে ঝোপের মধ্যে টেনে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে কয়েকজন ছাত্র৷ এ ঘটনায়ও সংশ্লিষ্ট পাঁচজন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়৷
এতগুলো ঘটনার মধ্যে কোনোটিতেই সঠিক তদন্ত করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ৷ এটা কি আসলে পুলিশের ব্যর্থতা, নাকি গাফিলতি? এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যে, পুলিশ এ সব ক্ষেত্রে একেবারেই আন্তরিক না৷ বরং অভিযোগকারী নারীই পদে পদে হয়রানির শিকার হন৷ পুলিশ তদন্তের নামে নানাভাবে হয়রানি করে ভিকটিমকেই৷'' তিনি গারো তরুণীর প্রসঙ্গে টেনে বলেন, ‘‘সে কিন্তু প্রথম যে পুলিশের কাছে গিয়েছিল, সেখানে সাহায্য পাইনি৷ একটা পর্যায়ে মিডিয়া সরব হলে পুলিশ এগিয়ে আসে৷''
ধর্ষিত গারো তরুণীর বড় বোনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাঁদের বাসা উত্তরায় হওয়ায় তাঁরা মামলা করার জন্য প্রথমে তুরাগ থানায় যান৷ কিন্তু অন্য এলাকার ঘটনা বলে পুলিশ রাত ৪টার দিকে তাঁদের ফিরিয়ে দেয়৷ এরপর ভোর ৫টার দিকে তাঁরা যান গুলশান থানায়৷ সেখানেও একই উত্তর মেলে৷ শেষে সাড়ে ৬টার দিকে ভাটারা থানায় গেলে বলা হয়, ওসি নেই, অপেক্ষা করতে হবে৷ এরপর শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওসি থানায় আসেন এবং তাঁদের কথা শুনে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তাঁদের মামলা নথিভুক্ত করা হয়৷
এদিকে রাজধানীতে চলন্ত মাইক্রোবাসে ধর্ষণের শিকার আদিবাসী তরুণীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছে হাইকোর্ট৷ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি কাজী ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার এ রুল দেয়৷ পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠনের করা একটি রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে এই বেঞ্চ তিনটি রুল ও দু'টি নির্দেশনা দেয়৷
অন্য একটি রুলে আদালত আরও জানতে চায়, ধর্ষণের শিকার তরুণীর প্রাথমিক অভিযোগ নিতে দেরি করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে না? দুই সপ্তাহের মধ্যে বিবাদিদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়৷ আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের সব থানায় ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-গোত্র ও জন্মস্থান নির্বিশেষে কোনো ব্যক্তির অভিযোগ গ্রহণ করতে যেন দেরি না করা হয়, সে জন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে৷
ঢাকা মেডিকেলের ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার'-এ চিকিৎসাধীন ধর্ষিত গারো তরুণীর সঙ্গে আলাপ করে এসে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী জানান, অপরাধীদের চিহ্নিত করা এবং তাদের আইনের আওতায় আনতে লড়াই চালিয়ে যাবে মেয়েটি৷ তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ আন্তরিক হলে অবশ্যই অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব৷'' তাই ১লা বৈশাখের ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি৷ মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকিও বলেন একই কথা৷ তিনি বলেন, ‘‘অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে পুলিশ সচেষ্ট হবে৷ ধর্ষিত এই তরুণীকে সব ধরনের সহযোহিতা দেয়া হবে৷
তরুণীর অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেলের ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার'-এর তত্ত্বাবধায়ক ডা. বিলকিস বেগম জানান, তাঁর শারীরিক অবস্থা এখন ভালো৷ তবে মানসিকভাবে ‘ডিপ্রেশনে' আছেন৷ মানসিকভাবে তিনি বেশি বিপর্যস্ত৷ হয়ত কাউন্সিলরের কাছে আরও কয়েকটি ‘সিটিং' লাগবে তাঁর৷ তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে৷ তাই তিনি যদি পরিবারের কাছে যেতে চান, তাহলে যেতে পারবেন৷
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার লুৎফুল কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশ আন্তরিকতার সঙ্গে মামলাটির তদন্ত করছে৷ শুধু তদন্তই নয়, তদন্ত তদারকির জন্য তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ ফলে আমাদের আন্তরিকতায় যে কোনো অভাব নেই, সেটা বোঝা যাচ্ছে৷ আমি আশা করছি, শিগগিরই অন্তত একজন ধর্ষক আটক হবে৷ এবং তার মাধ্যমে অন্যদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাদেরও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘শুধু এই মামলাটি নয়, সবগুলো ঘটনারই গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে৷''