পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় শক্তি!
১৬ মে ২০১৪সারা ভারতে বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে জনসমর্থনের যে হাওয়া, পশ্চিমবঙ্গেও তার ঝাপটা এসে পৌঁছাল৷ যদিও এবারের লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে দুটিতে জিতেছে বিজেপি, যা গত লোকসভা ভোটের থেকে একটি আসন বেশি৷ কিন্তু এ রাজ্যে বিজেপির ভোট বেড়েছে ১১ শতাংশ এবং বেশ কিছু কেন্দ্রে দ্বিতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাদের উত্থান হয়েছে, যা ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে নির্ধারিত বিধানসভা নির্বাচনের জন্য নিশ্চিতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে৷ বিশেষ করে যখন কেন্দ্রে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় থাকবে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার৷ অথচ এই নরেন্দ্র মোদীকেই কিছুদিন আগে কোমরে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর হুমকি দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷
একক শক্তিতে তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্য ভালো ফল করেছে পশ্চিমবঙ্গে৷ ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে ২৭টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ১৯টিতে জিতেছিল তৃণমূল৷ এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৪২টি আসনের সবকটিতেই প্রার্থী দিয়েছিলেন৷ মুখে ৪২টি আসনে জেতার কথা বললেও, অধিকাংশ আসনেই বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং বিজেপির সঙ্গে চতুর্মুখী লড়াইয়ে ৩৬ থেকে ৩৮টির বেশি আসনে জেতার আশা মমতা করছিলেন না৷ সেখানে ৩৪টি আসন জিতেছে তৃণমূল এবং রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসের ভোট কেটে বামফ্রন্ট প্রার্থী মহম্মদ সেলিমের জয়ের সম্ভাবনা নিশ্চিত করেছেন৷ হার হয়েছে কংগ্রেস প্রার্থী, কট্টর মমতা-বিরোধী বলে পরিচিত দীপা দাসমুন্সির৷
তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, তাঁদের নেতাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কুৎসা সত্ত্বেও মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছেন বলে ধন্যবাদ জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এই বিজয়কে মানুষের প্রতি উৎসর্গ করেছেন তিনি৷ প্রসঙ্গত সংবাদমাধ্যমকে দুষেছেন তৃণমূল নেত্রী, তাঁদের বিরুদ্ধে একজোটে, একতরফা প্রচার চালানোর জন্য৷ বিজেপির প্রচারে কোটি কোটি টাকা খরচের দিকে ইঙ্গিত করে মমতা প্রশ্ন তুলেছেন, মূল্যবোধের রাজনীতির যুগ কি তা হলে শেষ হয়ে গেল? এবার কি পয়সা ছড়িয়ে প্রচার করেই ভোট কেনা হবে!
অন্যদিকে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা বলেছেন, শাসকদল তৃণমূল যেরকম ব্যাপক হারে রিগিং করে, সন্ত্রাস ছড়িয়ে ভোট করল পশ্চিমবঙ্গে, তা তাঁদের কাছেও এক জরুরি শিক্ষা হয়ে থাকল৷ ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের সময় এই শিক্ষা তাঁরা মনে রাখবেন৷ আসানসোল লোকসভা কেন্দ্র থেকে ৭৪ হাজার ভোটে জেতা বিজেপির প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়-ও একই অভিযোগ এনেছেন শাসকদলের বিরুদ্ধে৷ দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে বিজেপি নেতা তথাগত রায় জিততে না পারলেও পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের দলের ভোটের হার বৃদ্ধির জন্য ভোটারদের অভিনন্দন জানিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন, এ রাজ্যে বিজেপির কাছে পাখির চোখ এখন পরের বিধানসভা নির্বাচন৷
আগের লোকসভা ভোটে জাতীয় কংগ্রেস জিতেছিল পশ্চিমবঙ্গের ছয়টি আসনে৷ এবার তারা জিতেছে চারটি আসনে৷ বহরমপুরে অধীর চৌধুরী, মালদা উত্তরে মৌসম বেনজির নুর, মালদা দক্ষিণে আবু হাসেম খান চৌধুরি, এবং জঙ্গিপুরে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়৷ বাকি দেশে কংগ্রেসের নির্বাচনি ভরাডুবির মধ্যে বরং পশ্চিমবঙ্গেই তাদের ফল কিছুটা ভালো৷ এর মধ্যে অধীর চৌধুরী রাজ্যের সমস্ত বিজয়ী প্রার্থীদের মধ্যে সবথেকে বেশি ব্যবধানে জিতেছেন৷ অধীর এদিন বলেছেন, এই রাজ্যে এতদিন রাজনীতি হতো দ্বিমুখী, বামপন্থি এবং অবামপন্থিদের মধ্যে৷ এবার এই লড়াইটা বহুমুখী হয়ে গেল৷
তবে এই লোকসভা ভোটের পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল বামফ্রন্ট৷ গত লোকসভা ভোটে ১৫টি আসনে জিতেছিলেন বাম প্রার্থীরা৷ সেখানে এবার অন্তত ছয়টি আসন বামেরা দখলে রাখতে পারবে বলে প্রাক-নির্বাচনি জনমত সমীক্ষায় মনে হয়েছিল৷ কিন্তু বামেদের হাতে এসেছে মাত্র দুটি আসন৷ তার মধ্যেও রায়গঞ্জে কংগ্রেসের ভোটে তৃণমূল ভাগ বসানোয় ও সংখ্যালঘু ভোটের কারণে মহম্মদ সেলিম জিততে পেরেছেন, তাও অতি সামান্য ব্যবধানে৷
তবে বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ে রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটের বেশিটাই সম্ভবত গিয়েছে তৃণমূলের পক্ষে৷ ৩৪টি আসনে নিশ্চিন্ত জয়ের সেটা একটা বড় কারণ হতে পারে৷ অন্যদিকে তফশিলি, উপজাতি ও অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণির ভোটের এক বড় অংশ সম্ভবত টেনে নিয়েছে বিজেপি, যা কার্যত বাম ভোটব্যাংকে ধস নামিয়েছে৷