বিজ্ঞান গবেষণায় কি মুসলিম স্বর্ণযুগ ফিরে আসবে?
২৭ আগস্ট ২০১১ইতিহাস
একটা সময় ছিল যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মুসলিমরাই এগিয়ে ছিল৷ বীজগণিত আবিস্কার করা থেকে শুরু করে চিকিৎসা, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান সবক্ষেত্রেই দাপটের সঙ্গে কাজ করেছে মুসলিমরা৷ ১৩ থেকে ১৭ শতক পর্যন্ত ইউরোপের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যবই ছিল ইবনে সেনার লেখা ‘দ্য ক্যানন অব মেডিসিন’ নামের চিকিৎসাবিদ্যার একটি বই৷ যেটা লেখা হয় ১০২৫ সালে ৷
মুসলিমদের এই স্বর্ণযুগ ছিল অষ্টম থেকে ১৩ শতকের মধ্যে৷ তখন বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবীরা বাস করতেন বাগদাদে, নয়তো কায়রোয়৷ কেউ কেউ তৎকালীন মুসলিম স্পেনের কর্দোবায়৷
কেন এমন হলো?
এ সম্পর্কে নানা মত রয়েছে৷ যেমন ১৩ শতকের দিকে মোঙ্গলদের আরব বিশ্ব দখল বা বিশ শতকের ঔপনিবেশিক শাসন এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন কেউ কেউ৷
অনেকে আবার ইসলাম বিষয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের ভুল ব্যাখ্যাকেও দায়ী মনে করেন৷ এঁদেরই একজন নিদহাল গুয়েসোম৷ তিনি আলজেরিয়ার জ্যোতির্বিজ্ঞানী৷ বর্তমানে কাজ করছেন আরব আমিরাতের ‘অ্যামেরিকান ইউনিভার্সিটি অব শারজাহ'তে৷ গুয়েসোম বলছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অংক কষে বলে দিতে পারেন কোন্ দিন কোন্ দেশে রোজা শুরু হওয়া উচিত৷ কিন্তু তাদের এই প্রস্তাব ধর্মীয় সংস্থাগুলো মানতে রাজি নন বলে জানিয়েছেন তিনি৷ তারা মনে করে যন্ত্র নয়, খালি চোখে চাঁদ দেখা সাপেক্ষেই রোজা শুরু হবে৷ কিন্তু গুয়েসোম বলছেন, এর ফলে কোনো কোনো দেশে ভুলবশত এক বা দুইদিন পরে রোজা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ কেননা মেঘের কারণে খালি চোখে তো চাঁদ দেখা নাও যেতে পারে!
শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানই নয়, মানুষের বিবর্তন, জিনতত্ত্ব বা নৃবিজ্ঞান এসব ক্ষেত্রেও গবেষণা করাটা ঠিক নয় বলে মনে করে অনেক ধর্মীয় সংগঠন৷ যেমন কিছু গোঁড়া খ্রিস্টান ধর্মীয় সংগঠন চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব মানতে রাজি নন৷
রাজনৈতিক ব্যবস্থা দায়ী?
এদিকে গত ৫০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে আরব বিশ্বে যে ধরণের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সেটাও এই অঞ্চলে বিজ্ঞান প্রসারে একটা বাধা হিসেবে দেখছেন অনেকে৷ যেমন ব্রিটেনে জন্ম নেয়া কান্তা আহমেদ৷ তিনি সৌদি আরবের একটি হাসপাতালে বছর দুয়েক কাজ করেছেন৷
আহমেদ বলছেন আরব বিশ্বে কারও মেধাকে গুরুত্ব দেয়া হয় না৷ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক বা গবেষক হিসেবে কাজ পেতে হলে মেধা নয়, থাকতে হয় ‘কানেকশন' অর্থাৎ উঁচু পর্যায়ের লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ৷ এছাড়া সেখানে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ কম৷ সাধারণভাবে সমাজে যে বিশ্বাস প্রচলিত এর বাইরে কেউ কিছু বললে সেজন্য তাঁকে বিরূপতার সম্মুখীন হতে হয়৷
শিশুরাও এক ধরনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে বড় হয়৷ ইচ্ছেমত প্রশ্ন করে করে শেখার যে অভ্যাস উন্নত বিশ্বের শিশুদের রয়েছে সেটা আরব বিশ্বের দেশগুলোতে নেই৷
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং দুর্নীতিও বিজ্ঞান চর্চায় আরেকটি বাধা৷ যার অন্যতম শিকার মিশরের আহমেদ জেওয়াইল৷ নোবেল জয়ী এই রসায়নবিদ কাজ করেছেন অ্যামেরিকার বিখ্যাত ‘ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি' ক্যালটেক'এ৷
১২ বছর আগে তিনি কায়রোতে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন৷ মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক তাঁর দুই বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের অনুমোদনও দেন৷ এছাড়া জেওয়াইলকে সম্মান জানাতে তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ খেতাব ‘অর্ডার অব দি নীল' দেয়া হয়৷ কথা ছিল, পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হবে৷ কিন্তু সেটা আর হয়নি৷
প্রকল্পের এক আদত ট্রাস্টি মোহাম্মদ আহমেদ ঘোনিম বলছেন মুবারক প্রশাসনের অনেকে জেওয়াইলের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি মেনে নিতে পারেনি৷ তাই তাঁর প্রকল্প যেন আলোর মুখ দেখতে না পারে সেই চেষ্টা তারা করেছে৷ কিন্তু আন্দোলনে মুবারকের পতনের পর এখন যারা দেশ পরিচালনা করছে তারা জেওয়াইলের প্রকল্প বাস্তবায়নের সব বাধা দূর করে দিয়েছে৷
বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, হয়তো এভাবেই কোনো একদিন মুসলমানরা আবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশ্বকে নতুন কিছু উপহার দিতে পারবে৷
প্রতিবেদন: জাহিদুল হক
সম্পাদনা: অরুণ শঙ্কর চৌধুরী