বিজ্ঞানশিক্ষায় এখন আর আনন্দ নেই
২২ আগস্ট ২০১৭বাংলাদেশে বিজ্ঞান আন্দোলনের পথিকৃত প্রবীণ এই অধ্যাপকের মতে, বিজ্ঞান শিক্ষায় এখন আর আনন্দ নেই, এটা হয়েছে যন্ত্রণাদায়ক৷ পাশাপাশি অভিভাবকরাই ঠিক করে দিচ্ছেন কে বিজ্ঞান পড়বে, আর কে পড়বে না৷ শিক্ষার্থীদের পছন্দ করে বিজ্ঞানে যাওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে৷
ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়?
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইব্রাহিম: গুরুত্ব তো দেয়া৷ আগে-পরে সবসময় বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া হয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সঠিকভাবে দেয়া হয় কিনা? বা যারা শিক্ষার্থী তাদের মনে রেখাপাত করে কিনা? বা সঠিকভাবে তাদের মধ্যে উৎসাহটা সৃষ্টি করতে পারে কিনা?
নবম শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থীরা বিভাগ পছন্দ করতে পারে৷ সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আকষর্ণ কতটা?
এটা একটা মারাত্মক ভুল কাজ৷ খুব তাড়াতাড়ি বিজ্ঞান থেকে চলে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে৷ অষ্টম শ্রেণির পর অনেককে আর বিজ্ঞানের মুখ দেখতেই হয় না৷ এটা ঠিক না, অতীতে এটা ছিল না, পরে এটা করা হয়েছে৷
বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, না কমছে?
এটা কমছে৷ প্রথমত বিজ্ঞানকে সবার থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে৷ বলা হয়, যাদের এটার প্রতি ঝোঁক বা প্রস্তুতি আছে, তারাই শুধু পড়বে৷ এটা একটা ভুল কাজ৷ বিজ্ঞান সবার জন্য পড়ার জিনিস৷ মুষ্টিমেয় এটা পড়াতে বাকিরা বলছে, আমরা ওখানকার নই৷ কারণ এদের মধ্যে এক ধরনের ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে৷ আর যাদের বিজ্ঞানে আনা হয়েছে তাদের জন্য ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করা হয়েছে, তাদের সিলেবাস কঠিন করা হয়েছে৷ আগে যেটা কলেজে পড়ানো হতো এখন সেটা স্কুলে পড়ানো হয়৷ এটা একটা যন্ত্রণার কাজে পরিণত হয়েছে৷ ছাত্ররা বিজ্ঞান শিখছে ব্যথার মতো, আনন্দের মতো করে তাদের এটা শেখানো হচ্ছে না৷ আনন্দের মধ্যে যদি আমরা বিজ্ঞানের বই পড়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারতাম তাহলে উপন্যাসের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে তারা বিজ্ঞানের বইও পড়ত৷
শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানচর্চা করে, নাকি চাকরির দিকে বেশি ঝোঁকে?
শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, আমরা অভিভাবকরা, সমাজ সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ দিচ্ছি৷ ওরা চাকরির পেছনে দৌঁড়াচ্ছে না, অভিভাবকরা দৌঁড়াচ্ছে৷ শিক্ষার্থীরা আনন্দ চায়৷ এ কারণে অনেক শিক্ষার্থী সব অগ্রাহ্য করে চিত্রকলা পড়তে যায়৷ এটা কিন্তু অনেকেই পছন্দ করে না৷ সুযোগ দিলে সবাই নিজের আনন্দের পথেই চলত৷ সমাজ তাকে বাধ্য করছে তোমাকে চাকরির পথে হাঁটতে হবে৷ চাকরির বাজার যেখানে উঁচু, সেখানেই তোমাকে যেতে হবে৷ এ কারণে নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব বিভাগ বিজ্ঞানে অনেক অবদান রেখেছিল এখন সেখানে ছাত্র পাওয়া যায় না৷ পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞানের মতো জায়গায় ছাত্ররা আসে না৷
দেশে কি বিজ্ঞানের চর্চা কমে যাচ্ছে?
এতক্ষণ যা বললাম তার ফলশ্রুতিতে কী আশা করা যায়? যদি আনন্দ চলে যায়, আকাঙ্খা চলে যায়, নেশা চলে যায় তাহলে কি হবে? চর্চা জিনিসটা তো নেশা বা আকাঙ্খার ব্যাপার৷ আমরা ছোটবেলা থেকে যদি তাদের মধ্যে এটা ঢোকাতে পারতাম তাহলে দেখা যেত অনেক ছাত্র চর্চায় লেগে যেত৷ চর্চা তো এক ধরনের ত্যাগ স্বীকার করা, এটা এক ধরনের গবেষণা৷ এটা কর্পোরেট কাজ না৷ আমাদের দেশে কর্পোরেট গবেষণা নেই৷ বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা গবেষণার জন্য কোটি কোটি ইউরো খরচ করছে, আমাদের দেশে এই ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই৷
বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপ কি দেশে আছে?
অবশ্যই আছে৷ তবে সিস্টেম বদলাতে হবে৷ বিভাজনটা তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করতে হবে৷ অন্তত স্কুলে যতদিন আছি, বিজ্ঞানটা সবাইকে পড়তে হবে৷ এমনকি কলেজে গেলেও অন্য ছাত্রদেরও সাধারণ বিজ্ঞান পড়তে হবে৷ আর বিজ্ঞানের ছাত্রদের সাধারণ সমাজবিজ্ঞান থাকবে, যেটা আগে ছিল৷ অথচ ক্লাস এইটের একজন ছাত্রকে বলে দেয়া হচ্ছে এটা তোমার লাইন না, তোমার বিজ্ঞান পড়ার দরকার নেই৷ এরপর সে বিজ্ঞানে কি হচ্ছে বা না হচ্ছে সে তার কিছুই জানে না৷
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কি বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য দক্ষ শিক্ষক আছেন? শিক্ষকের সংখ্যা কি পর্যাপ্ত?
শিক্ষক কে হবে? আমি যাদের কথা বলছি, এরাই তো শিক্ষক হবে৷ শিক্ষক তো আমি জার্মানি থেকে আনব না৷
বিজ্ঞান পড়লে খরচটা বেড়ে যায়, এমন একটি ধারণা কাজ করে আমাদের সমাজে৷ সেটা কি কমানো সম্ভব?
এটা আমার মনে হয় সত্য নয়৷ প্রথম কথা হল- আমাদের যে পাবলিক সিস্টেম সেখানে কোনটাতেই কোনো খরচ নেই৷ আর যেটা আছে, সেটা সমানভাবেই আছে৷ প্রাইভেট সিস্টেমে সবকিছুতেই খরচ৷ সেটা যদি আপনি ইংরেজি সাহিত্য পড়তে যান সেখানেও লাখ লাখ টাকা নেবে আপনার কাছ থেকে৷ আমাদের দেশে যে কোনো দেশের চেয়ে খরচ কম৷
বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে মূল সমস্যাগুলো কী?
সিস্টেমটাকে অন্য চোখে দেখতে হবে, সার্বজনীন করতে হবে৷ সবার কাছে বিজ্ঞান নিয়ে যেতে হবে, আনন্দদায়ক করতে হবে৷ বেশি উচ্চাকাঙ্খী হলে হবে না৷ তুমি বিজ্ঞানে এসেছ তোমাকে সব অংক করতে হবে, সবকিছু করতে হবে এমন করলে হবে না৷ এটা কোনো দেশেই নেই৷ বরং ভিত্তিটা ভালো করতে হবে৷ আমরা কিন্তু সেটাতে বিশ্বাস করি না৷ এ বছর যদি বই ৩০ পৃষ্ঠা থাকে তাহলে পরের বছর আমরা সেটা ৫০ পৃষ্ঠা করি৷ বলা হয় তার জ্ঞান বেড়ে গেছে৷ যদি জ্ঞান বেড়েই যায় তাহলে তো সেটা ৫০০ গুন হওয়ার কথা৷ জ্ঞান বাড়া আর ফাউন্ডেশন তৈরি এক জিনিস না৷ হ্যাঁ, প্রয়োজন হলে আমরা পরিবর্তন করব৷ কিন্তু তার মধ্যে আনন্দের জিনিস থাকতে হবে৷ এটা পেইনফুল হয়ে গেছে৷
আপনি তো এতক্ষণ নানা সমস্যার কথা বললেন৷ এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারি কীভাবে?
প্রথমত, সবাই বসে চিন্তা করতে হবে৷ অন্যের কথা শুনতে হবে, বলার একটা সুযোগ থাকতে হবে৷ কর্তৃপক্ষকে একটু বিনয়ী হতে হবে, যে আমরা যেটা বলে ফেলেছি, এটাই শেষ কথা নয়৷ যাদের সমস্যা তাদের নিয়ে বসতে হবে৷ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, কেন তারা ভয় পাচ্ছে৷ অনেক সময় বলা হয় স্কুলটা ভালো না, শহরের স্কুল, না গ্রামের স্কুল – আসলে স্কুলটা কিন্তু অত গুরুত্বপূর্ণ না৷ বিজ্ঞানের ফাউন্ডেশনটা করতে হবে, অত বেশি যন্ত্রপাতি লাগে না৷ আমাদের রান্নাঘরে যা আছে তাই দিয়েও শুরু হতে পারে৷ আসলে পাগল শিক্ষক, পাগল ছাত্র না থাকলে তো এটা হবে না৷ এখনও অনেকে বিজ্ঞানের বই ঘাঁটে, কিন্তু যদি দেখে পরীক্ষায় সেটা লাগবে না তাহলে সে ওটা আর দেখে না৷ আমাদের লক্ষ্যটা ন্যারো হয়ে গেছে৷ অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক হয়ে গেছে৷ প্রতিযোগিতা ঠিক আছে, কিন্তু এর বিষয়টা আরো বিস্তৃত হওয়া দরকার৷
আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷