বিজয়ের পতাকা যেভাবে পেলো বাংলাদেশ
লাল-সবুজের এই পতাকা শুধু দেশমাতৃকার পরিচয় নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও চেতনা৷ ছবিতে তুলে ধরা হলো বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার গৌরবোজ্জ্বল পথ পরিক্রমা৷
প্রথম জাতীয় পতাকা
সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের প্রতীক গাঢ় সবুজ রঙ, তার মাঝে বিপ্লবের প্রতীক লাল সূর্য৷ সূর্যের মাঝখানে সোনালি বাংলাদেশের প্রতীক সোনালি মানচিত্র– বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার নকশা ছিল এমন৷ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তা সাত কোটি মানুষকে সাহস জুগিয়েছে৷ ছবি: মুক্তির গান৷
পতাকার জন্মকথা
১৯৭০ সালের ৭জুন ঢাকার পল্টন ময়দানে একটি সামরিক কুচকাওয়াজে আসবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) একটি কক্ষে ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ সংগঠনের কয়েকজন কর্মী এবং ছাত্রনেতারা পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন৷ ঢাকার নিউমার্কেট থেকে সবুজ কাপড় কিনে তাতে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনা হয়৷ লাল বৃত্তের মাঝে মানচিত্র আঁকেন শিবনারায়ণ দাস৷
প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন
১৯৭১ সালের ২মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-র তৎকালীন ভিপি আ স ম আবদুর রব৷ তার সঙ্গে পতাকাটির নকশা চূড়ান্তে আরো ছিলেন ছাত্রনেতা শাহজাহান সিরাজ, হাসানুল হক ইনু, ইউসুফ সালাহউদ্দিন আহমেদ, কামরুল আলম খান (খসরু) প্রমুখ৷
বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে পতাকা
বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে নিজ বাসভবনে প্রথমবার জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন৷ ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এই পতাকা ব্যবহৃত হয়৷ ছবি: ১৯৭১-এর ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় বিধ্বস্ত শহিদ মিনারের সামনে বাংলাদেশের তখনকার পতাকা হাতে জনতা৷
পরিমার্জিত পতাকা
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ৷ ১৯৭২ সালে চিত্রকর কামরুল হাসানকে পতাকার মাঝের মানচিত্র বাদ দিয়ে মাপ ও রঙসহ নতুন নকশা এবং এর ব্যাখ্যা সম্বলিত একটি প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব দেন বঙ্গবন্ধু৷ সবুজ আয়তক্ষেত্রের মাঝে লাল বৃত্ত রেখে পতাকা পরিমার্জন করেন কামরুল হাসান৷
মানচিত্র সরিয়ে লাল-সবুজ
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি জাতীয় পতাকা থেকে সোনালি মানচিত্র সরিয়ে ফেলা হয়৷ এরপর ১৭ জানুয়ারি এই নতুন রূপ সরকারিভাবে গৃহীত হয়৷ সবুজ রং বাংলার প্রকৃতি ও চিরতারুণ্যের প্রতীক৷ বৃত্তের লাল রঙ উদীয়মান সূর্য এবং মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের আত্মত্যাগের প্রতীক৷
জাতীয় পতাকার মাপ
১৯৭২ সালে জাতীয় পতাকা বিধিমালা জারি করা হয়৷ তিন নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, পতাকার দৈর্ঘ্য ১০ ফুট ও প্রস্থ হবে ছয় ফুট৷ লাল বৃত্ত পতাকার দৈর্ঘ্যের এক-পঞ্চমাংশ ব্যাসার্ধ, অর্থাৎ দুই ফুট৷ পতাকার দৈর্ঘ্যের সাড়ে চার ফুট ওপরে প্রস্থের মাঝ বরাবর অঙ্কিত আনুপাতিক রেখার ছেদবিন্দু হবে লাল বৃত্তের কেন্দ্র৷
পতাকার রং
বিধি অনুযায়ী, গাঢ় সবুজ রঙের মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত থাকে৷ পতাকার সবুজ পটভূমি প্রতি হাজারে প্রোসিয়ন ব্রিলিয়ান্ট গ্রিন এইচ-২ আর এস ৫০ পার্টস৷ লাল বৃত্তাকার অংশটি প্রতি হাজারে প্রোসিয়ন ব্রিলিয়ান্ট অরেঞ্জ এইচ-২ আর এস ৬০ পার্টস৷
মানব পতাকার বিশ্বরেকর্ড
২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ঢাকার শেরেবাংলা নগরের জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ২৭ হাজার ১১৭ জন মানুষ ‘মানব পতাকা’ গঠন করে বিশ্বরেকর্ড গড়ে৷ গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানব পতাকা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেই উদ্যোগ৷
যানবাহনে পতাকা
রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মোটরযান, নৌযান এবং উড়োজাহাজে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা যায়৷ এছাড়া জাতীয় সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী বা একই পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ, চিফ হুইপ, জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ কূটনৈতিক/কনস্যুলার/ মিশনের প্রধান ভ্রমণকালীন মোটরযান ও নৌযানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করতে পারেন৷
পতাকা উত্তোলন দিবস
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রীবর্গ, চিফ হুইপ ও পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ চেয়ারম্যানের বাসভবন, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব কর্মদিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়৷ ঐতিহাসিক দিবস, ঈদে মিলাদুন্নবী এবং বিশেষ দিবসে বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়৷
পতাকা অর্ধনমিত রাখা
২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস এবং সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত বিশেষ দিবসে পতাকা অর্ধনমিত থাকে৷ এক্ষেত্রে খুঁটির ওপর থেকে পতাকার প্রস্থের সমান নীচে রাখা হয়৷
বিদেশে প্রথম পতাকা উত্তোলন
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল ভারতের কলকাতায় তৎকালীন পাকিস্তান উপ-হাইকমিশনে কর্মরত উপ-হাইকমিশনার এম হোসেন আলী প্রথমবার বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন৷ বিদেশের মাটিতে সেটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন৷ আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য টেবিল পতাকার মাপ ১০*৬ ইঞ্চি৷ ছবি: ২০১১ সালে স্বাধীনতা দিবসে বার্লিনে বাংলাদেশ দূতাবাসের পতাকা উত্তোলন৷
জাতীয় দিবসে পতাকা সেলাইয়ের ধুম
২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশে জাতীয় পতাকার চাহিদা বাড়ে৷ ঢাকার মাতুয়াইলে বিভিন্ন কারখানায় দর্জিরা লাল-সবুজ কাপড় দিয়ে বুনতে থাকেন বিভিন্ন আকারের পতাকা৷ তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি৷
মাস্কে পতাকা
করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বানানো মাস্কেও জুড়ে দেওয়া হয়েছে লাল-সবুজের আবেগ৷ স্বাধীনতার মাসে চোখে পড়েছে এমন দৃশ্য৷ এছাড়া বিভিন্ন বিপণি বিতানে ও রাস্তার ধারে ছোট-বড় সবার পোশাকে লাল-সবুজ রঙের প্রভাব দেখা যায়৷
লাল-সবুজের বাংলাদেশ
স্বাধীনতা ও বিজয়ের মাসে পরম মমতায় জাতীয় পতাকা ওড়ান অনেকে৷ মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের চেতনায় লাল সবুজের বাংলাদেশ হয়ে থাক অপরূপ৷