বিদেশি চ্যানেলের দর্শক আর লাভ ক্ষতির খতিয়ান
৮ অক্টোবর ২০২১সরকারের এই সিদ্ধান্তে দেশি টিভি চ্যানেলগুলো অর্থনৈতিক লাভের আশা দেখছে৷ তবে ক্যাবল অপারেটররা বলছেন তাদের গ্রাহক কমে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশে টিভি চ্যানেলের মান উন্নত না করলে গ্রাহক কমতেই থাকবে৷ টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকরাও বলছেন এই সুযোগে অনুষ্ঠানের মান উন্নত করতে তারা কাজ করছেন৷
কত দর্শক, কোন চ্যানেল দেখে:
বাংলাদেশে ‘সিরিয়াস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান টিভি চ্যানেলের রেটিং পয়েন্ট (টিআরপি) করে৷ তবে গত চার মাস ধরে নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা তা করছে না৷ প্রতিষ্ঠানটি এখন নাম পরিবর্তন করে ‘কান্তার’ নামে আত্মপ্রকাশ করেছে৷ তারা এখন সরকারের নীতিমালা মেনে ফের টিআরপি করার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে৷ প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র গবেষণা কর্মকর্তা রাবেয়া সুলতানা বাঁধন জানান, তারা আগে যখন টিআরপি করতেন তখন বাংলাদেশের দর্শকদের ঘন্টা হিসেবে টিভি দেখার সময়ে শতকরা ৮০ ভাগ ছিলো বিদেশি চ্যানেল৷ তারমধ্যে আবার ৬০ ভাগ ছিলো ভারতীয় চ্যানেল৷ তারা ৩১টা বাংলাদেশি চ্যানেল ও ৭০টা বিদেশি চ্যানেলের টিআরপি তৈরি করত৷ আর তাতে শীর্ষে সব সময়ই ভারতীয় চ্যানেল থাকত বলে তিনি জানান৷ ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৫৫০টি বাসায় ডিভাইসের মাধ্যমে এই টিআরপি করা হতো৷ দর্শকেরা কত ঘন্টা টিভি দেখে এবং তারমধ্যে কোন চ্যানেল কত সময় দেখে তার ভিত্তিতে টিআরপি করা হয়৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের দর্শকেরা কেন ভারতীয় টিভি বেশি দেখেন তার কোনো গবেষণা আমরা করিনি৷ তবে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন৷’’
কেবল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) হিসেবে তাদের গ্রাহক বা কানেকশন আছে এক কোটিরও বেশি৷ দর্শক সাত-আট কোটি হবে৷ প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি আনোয়ার পারভেজ জানান, ক্লিন ফিডের আগে মোট ১০০ বিদেশি চ্যানেল তারা দেখাতেন৷ তার মধ্যে ৬৫টি ভারতীয়৷ আর বাংলাদেশি ৩১টি চ্যানেল তারা দেখান৷ তিনি বলেন, ‘‘ভারতীয় চ্যানেলের প্রতি বাংলাদেশের নারীদের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি৷ তবে এর কারণ আমরা কখনোই অনুসন্ধান করে দেখিনি৷’’
তার এই কথার সত্যতা পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের এক গবেষণায়৷ তাদের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের নারীরা টেলিভিশন বেশি দেখেন৷ তাদের মধ্যে ৬০ ভাগ দেখেন স্টার জলসাসহ ভারতীয় চ্যানেল৷ বাংলাদেশ ক্যাবল টিভি দর্শক ফোরামের সভাপতি এরফানুল হক নাহিদ বলেন, ‘‘আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে করোনার সময় নারীদের টিভি দেখা আরো বেড়ে গেছে৷ আর তাদের কাছে প্রধান আকর্ষণ ভারতীয় বাংলা এবং হিন্দি চ্যানেলের সিরিয়াল৷’’ তারা ২০১৪ সালে একটি জরিপও করেছিল৷ সেই জরিপে বলা হয় দেশের টেলিভিশন দর্শকের ৭০ ভাগ ভারতীয় চ্যানেল দেখে৷
কেন ক্লিন ফিড:
বিজ্ঞাপন ছাড়া টিভি ট্রিমিং হলো ক্লিন ফিড৷ একুশে টেলিভিশনের হেড অব নিউজ এন্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স রাশেদ চৌধুরী জানান, বাংলাদেশে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের বাজার বছরে ২১-২২ হাজার কোটি টাকার৷ আর বাংলাদেশে যে ভারতীয় চ্যানেলগুলো সম্প্রচার হয় তারা কমপক্ষে আট হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন নিয়ে যায়৷ কিন্তু বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল ভারতে দেখা যায় না৷ এখন ক্লিন ফিড নীতির কারণে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপনের বাজার আরো বড় হবে৷
তিনি বলেন, ‘‘তারা যে পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয় সেই ভারতীয় পণ্যও বাংলাদেশের বাজার দখল করছে৷ সেই ক্ষতির হিসাব করলে সেটা অনেক৷ ভারতীয় চ্যানেলের এই বিজ্ঞাপন থেকে সরকার কোনো ট্যাক্স পায়না৷ অথচ আমরা ট্যাক্স দেই৷’’
টেলিভিশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সহ- সভাপতি মোজাম্মেল বাবু জানান, ‘‘ক্লিন ফিড আইন হয় ২০০৬ সালে৷ বিধিমালা তৈরি হয় ২০১০ সালে৷ ২০১৫ সাল থেকে এটা বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়া হয়৷ ২০১৮ সালে সময় বেধে দেয়া হয়৷ তারপরও নানা অজুহাতে এটা বাস্তবায়ন হয়নি৷ কেবল অপারেটটরা প্রথমে করোনার অজুহাত দেয়৷ এরপর বলে ভারতীয় চ্যানেল না দেখালে আমাদের খরচ ওঠে না৷’’
এর জবাবে আনোয়ার পারভেজ বলেন, ২০০৪ সালে আমরাই প্রথম ক্লিন ফিডের কথা বলেছিলাম৷ তখন আমাদের সাথে কেউ ছিলোনা৷ সংযোগ দিয়ে মাসিক গ্রাহক ফি আমাদের আয়ের উৎস৷ ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ থাকলে গ্রাহকেরা সংযোগ রাখবেন না৷ এরইমধ্যে তারা সংযোগ না রাখার কথা বলছেন৷ এই মাস শেষে বিল আনতে গেলে তারা হয়তো বিলও দেবেন না৷ আমরা কোথায় যাব?
বিকল্প পথে ভারতীয় চ্যানেল
ভারতীয় চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে বন্ধ হওয়ার পর এখন তারা ইউটিউবের ওপর জোর দিচ্ছে৷ বাংলাদেশের দর্শকেরাও এখন ভারতীয় সিরিয়াল দেখার জন্য ইউটিউব এবং ওটিটি প্লাটফর্মে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে৷ তারা এখন ফ্রি দেখার জন্য বলছে৷ ভবিষ্যতে হয়তো চার্জ আরোপ করবে৷ আনোয়ার পারভেজ বলেন, ‘‘তাদের অনুষ্ঠান আটকে রাখা কঠিন হবে৷ আমরা দেখছি ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল এবং অনুষ্ঠান দ্রুত ইউটিউবে আপ হচ্ছে৷ আর দ্রুত ভিউ বেড়ে যাচ্ছে৷’’
মোজাম্মেল বাবু বলেন, ‘‘সরকার তো ডিটিএইচও বন্ধ করেছে ৷ এখন ওটিটি এবং ইউটিউবও বন্ধ করতে হবে৷ বন্ধের নীতিমালা করতে হবে৷’’ তবে তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মান উন্নত করতে হবে৷ দর্শকের চাহিদা পুরণ করতে হবে৷ তা না হলে শুধু আইন করে দর্শক ধরে রাখা যাবেনা৷ একই কথা বলেন রাশেদ চৌধুরী৷ তার কথা, ‘‘মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান তৈরির কোনো বিকল্প নাই৷’’
ভারতে বাংলাদেশি চ্যানেল কেন দেখা যায় না
ভারতে বাংলাদেশি চ্যানেল সম্প্রচারে কোনো বাধা নেই৷ কিন্তু সেখানে শুল্ক বাধা রয়েছে৷ বাংলাদেশের একটি চ্যানেল সম্প্রচারের জন্য বছরে ভারতীয় কেবল অপারেটদের গুণতে হবে সাত কোটি রুপি৷ ফলে কেউ সম্প্রচার করে না৷ আর বিপরীতে বাংলাদেশে প্রতিটি ভারতীয় চ্যানেল দেখাতে বছরে দিতে হয় মাত্র ছয় লাখ টাকা৷
মোজাম্মেল বাবু বলেন, ‘‘এটা একটা অসম প্রতিযোগিতা৷’’
এখন আর বিদেশি চ্যানেল বন্ধ তা বলা যাচ্ছে না৷ কারণ ক্লিন ফিড দিয়ে ২১টি বিদেশি চ্যানেল সম্প্র্রচার শুরু করেছে৷ ভারতীয় চ্যানেলগুলো ক্লিনফিড না দেয়ায় তাদের সম্প্রচার বন্ধ আছে৷ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বলেছেন, ক্লিনফিড নীতি মেনে বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারে কোনো বাধা নেই৷