ভারতে যেতে ভয়
১৩ ডিসেম্বর ২০১৩সাম্প্রতিক একটি ঘটনা সারা ভারতেরই ভরসার ভিত নড়িয়ে দিয়েছে৷ বেঙ্গালুরু প্রবাসী এক বাঙালি মহিলা তথ্য-প্রযুক্তি কর্মী তাঁর অফিসের আরও অনেকের সঙ্গে কেরলে বেড়াতে গিয়েছিলেন৷ ওঁরা সবাই ছিলেন কেরলের পূভারে একটি বেশ নামকরা রিজর্টে৷ ওই রিজর্টের দুই কর্মী ৪০ বছর বয়সি ওই মহিলার ঘরের পিছনের দরজার ছিটকিনিটি অকেজো করে রেখে, মাঝরাতে মহিলার ঘরে ঢোকে এবং মহিলাকে ধর্ষণ করে৷ পুলিশি তৎপরতায় অবশ্য দুই অপরাধীই ধরা পড়েছে, কিন্তু ভারতের ১০০ শতাংশ স্বাক্ষর রাজ্য এবং পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ বলে পরিচিত কেরলের ইমেজে কালি মাখিয়েছে ওই ধর্ষণের ঘটনা৷
ভারতের বিভিন্ন পর্যটক আকর্ষণের জায়গায় এখন মহিলা পর্যটকদের জন্যে, বিশেষ করে বিদেশিনিদের জন্যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে যৌন হেনস্থার ভয়৷ সাধারণভাবে যেসব পর্যটনকেন্দ্র ভারতে জনপ্রিয়, সেই দিল্লি, আগ্রা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং গোয়ায় প্রায়ই শোনা যাচ্ছে বিদেশি মহিলা পর্যটকদের যৌন লাঞ্ছনার ঘটনা৷ পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য বলে সুনাম অর্জন করা হিমাচল প্রদেশেও মাদকজনিত অপরাধ, রাহাজানি, যৌন নিগ্রহ এমনকি খুনের মতো গুরুতর অপরাধও ঘটেছে, যদিও বিক্ষিপ্তভাবে৷ সেই তালিকায় নবতম সংযোজন দক্ষিণ ভারতের কেরল, পর্যটন দপ্তরের বিজ্ঞাপনে যে রাজ্যকে “গডস ওন কান্ট্রি”, অর্থাৎ স্বয়ং ঈশ্বরের প্রিয় জায়গা বলে অভিহিত করা হয়!
তবে ভারতের যে জায়গা থেকে প্রায়ই পর্যটকদের অভিযোগ আসে, ঘটনাচক্রে সেই গোয়ার সমুদ্রসৈকতই ভারতে বিদেশি পর্যটকদের সবথেকে পছন্দের গন্তব্য৷ সম্প্রতি গোয়াতে এক জার্মান যুবতীর অভিযোগের ভিত্তিতে এক ভারতীয় যোগব্যায়াম প্রশিক্ষক পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে৷ কৃষ্ণ শর্মা নামে উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা ৩৬ বছরের ওই যোগগুরুর সঙ্গে অভিযোগকারিনী জার্মান পর্যটকের আলাপ হয়েছিল গোয়ার আঞ্জুনা সৈকতের একটি পার্টিতে৷ পার্টির পর কৃষ্ণ মহিলাকে ছেড়ে দিতে তাঁর গেস্ট হাউস পর্যন্ত গিয়েছিল৷ সেখানেই সে মহিলাকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ উল্লেখ্য, এই বছরেরই মার্চে একেবারে একই ধরনের একটি যৌন অপরাধের অভিযোগ দায়ের হয়েছিল খাস কলকাতা শহরে৷ সেক্ষেত্রেও পার্টিতে আলাপ হওয়া এক বিদেশিনীকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিল কলকাতার এক যুবক৷
পুলিশের বক্তব্য, ভারতের মতো দেশে, যেখানে ছেলে-মেয়েদের মেলামেশা পশ্চিমী দেশের মতো অত সহজ এবং সাবলীল নয়, সেখানে সদ্য আলাপ হওয়া লোকজনের ব্যাপারে বিদেশি পর্যটকদের সাবধান থাকাই উচিত৷ কিন্তু বিদেশিরা যেহেতু এমনতর বিধিনিষেধ মেনে মেলামেশায় অভ্যস্ত নয়, তাঁরা সহজেই ফাঁদে পা দেন৷ তবে যেখানে অটো বা ট্যাক্সি ড্রাইভার, কিংবা হোটেলের কর্মীদের হাতে বিদেশি মহিলা পর্যটকদের যৌন হেনস্থা হচ্ছে, সেখানে পুলিশ বা প্রশাসন দায় এড়াতে পারে না৷ যদিও সব ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা পুলিশের নজরদারি সম্ভবও নয়৷ সেজন্য ভারতে যাঁরা পর্যটকদের সরাসরি সংস্পর্শে আসেন, তাঁদের সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷
কিন্তু তাতে কি আদৌ কোনও কাজ হচ্ছে! যেমন গত প্রায় দু-তিন বছর ধরে ভারতে শুরু হয়েছে এক সরকারি প্রচার, যার শিরোনাম হলো ‘‘অতিথিদেব ভব৷'' অর্থাৎ অতিথি যে দেবতার সমান, শতাব্দী প্রাচীন সেই ভারতীয় মূল্যবোধের কথা স্মরণ করিয়ে বিদেশিদের প্রাপ্য সম্মান এবং সমাদর নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা করছে সরকার৷ কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রকের এক টিভি বিজ্ঞাপনে হিন্দি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা আমির খান হাজির হয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছেন অতিথি সৎকারে ভারতীয় ঐতিহ্য এবং পরম্পরার কথা৷ অতি সম্প্রতি আমির খান এবং ভারতীয় দুরদর্শনের যৌথ প্রযোজনা, দেশে-বিদেশে ভারতীয় দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় ‘‘সত্যমেব জয়তে'' অনুষ্ঠানের প্রোমোতে দেখানো হচ্ছে দিল্লির এক পাঞ্জাবি শিখ অটো চালককে, যিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এক বিদেশি মহিলা পর্যটককে আরও দুই অটোচালকের লালসার হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন৷
কিন্তু বাস্তব পরিস্থির তাতে উন্নতি হচ্ছে সামান্যই৷ চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ভারতে বিদেশি মহিলা পর্যটকের সংখ্যা, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ শতাংশ কম ছিল৷ বছরের মাঝামাঝি সময়ের হিসেব, এবার ভারতে বিদেশি পর্যটকদের বুকিং আগের বছরগুলোর তুলনায় ২৫ শতাংশ কম হয়েছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যটনমন্ত্রী চিরঞ্জিবী সংসদে দাঁড়িয়ে স্বীকার করেছেন, ভারতে মহিলাদের যৌন নিগ্রহের ঘটনায় পর্যটনশিল্পে প্রভাব পড়েছে, মার খাচ্ছে পর্যটন৷