আগেও সাম্প্রদায়িকতা ছিল, এখনো আছে
৬ মে ২০২০প্রায় সাত বছর ধরে নিম্ন আয়ের মানুষদের মাত্র এক টাকায় খাবার খাইয়ে আসছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন৷ এছাড়া প্রায় দু’ হাজারের মতো শিশুকে লেখাপড়া করানো, এতিমখানা পরিচালনা, ‘বাসন্তি প্রজেক্ট’-এর মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখার কারণেও গত কয়েক বছরে বহুবার খবরে এসেছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন৷
তবে মঙ্গলবার সংগঠনটির ইতিহাসে সম্ভবত প্রথমবারের মতো কোনো নেতিবাচক খবর নিয়ে শিরোনামে এলো বিদ্যানন্দ৷ জানা গেল, চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন কিশোর কুমার দাস৷
কেন?
কোনো অপরাধ করেননি তো কিশোর?
না, বরং করোনা মহাসংকটেও মানবসেবায় ব্রতী ছিলেন তিনি৷
দেশের চিকিৎসক, নার্সরা যখন পিপিই-র অভাবে চিকিৎসাসেবা দিতে ভয় পাচ্ছিলেন বিদ্যানন্দ তখন পিপিই বানিয়ে পৌঁছে দিয়েছে তাদের কাছে৷ মসজিদ, হাসপাতাল, বাস স্ট্যান্ড, রেলস্টেশনসহ অনেক জায়গায় জীবাণুনাশক ছিটিয়েছে৷ সাধারণ মানুষের জন্য হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী বেসিন বসিয়েছে, হাত ধোয়ার জন্য পানি ও সাবান সরবরাহ করেছে বিদ্যানন্দ৷ হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক ইত্যাদি তৈরি করে বিতরণ করেছে খেটে খাওয়া মানুষদের মাঝে৷ যেখানে সম্ভব নিজেদের স্বেচ্ছাসেবীরা ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন দরিদ্র মানুষদের কাছে আর যেসব জায়গায় নিজেদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় সেখানে সেনাবাহিনী ও কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় ত্রাণ বিতরণ করছে বিদ্যানন্দ৷ বিভিন্ন এলাকায় দুস্থ মানুষদের ইফতার এবং সেহেরিও দিচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠন৷
যখন ত্রাণ চুরির খবরে, চিকিৎসক, নার্স বা সাধারণ কোনো ভাড়াটের প্রতি বাড়িওয়ালার নিষ্ঠুরতায় ক্ষোভে, ঘৃণায় বিষন্ন হচ্ছিলাম, বিদ্যানন্দের এসব সেবামুলক কাজের খবর তখন অনেক ভরসা দিয়েছে৷
তাহলে কেন পদত্যাগ করলেন কিশোর কুমার দাস?
মুল কারণ তার ধর্মীয় পরিচয়৷
এ কারণে সংগঠনের বাইরে যে তাকে চরম আপত্তিকর ও অপমানজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছিল, মঙ্গলবার বিদ্যানন্দের ফেসবুক পাতায় অবশ্য তা স্বীকার করা হয়নি৷ স্বীকার করা হয়েছিল শুধু কারো কারো কাছে সংগঠনের নাম আপত্তিকর মনে হওয়ার ব্যাপারটা৷
কারো কারো নাকি মনে হয়েছিল, বিদ্যানন্দ নামটা ভীষণ অগ্রহণযোগ্য৷
গতকাল ওই মানুষগুলোর কাছে একরকম জবাবদিহিই করলো বিদ্যানন্দ৷
ফেসবুক পাতায় লেখা হলো, ‘‘বিদ্যানন্দ নামটি দিয়েছেন এক মুসলিম ব্র্যান্ড এক্সপার্ট৷ ‘আনন্দের মাধ্যমে বিদ্যা অর্জন' স্লোগানে তিনি এই নাম দিয়েছিলেন৷ অনেকেই ব্যক্তির নাম থেকে বিদ্যানন্দ নামের উদ্ভব ভেবে ভুল করেন৷ এজন্য তারা নাম পরিবর্তন করতে চাইলেও স্বেচ্ছাসেবকরা রাজি হননি৷’’
ঘরের কর্মহীন পরিসর থেকে কিছু লোকের প্রকাশ্যে বা গোপনে করা অযৌক্তিক মন্তব্যের চাপে বিদ্যানন্দ যে নাম পরিবর্তন করে আরো কিছু সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধকে পুলকিত হওয়ার সুযোগ দেয়নি, সে কারণে অসংখ্য ধন্যবাদ৷
জানি, কর্মকেও ‘ধর্ম’ মানলে ধর্ম পালন আরো ভালোভাবে হয়, কিন্তু শুধু সুকর্মে বাধা দিলে ধর্মপালন যে অপূর্ণ থেকে যেতে পারে, তা অনেকে মানবেন না৷
জানি, যতই বলি ‘‘নামে কী বা আসে যায়’’, আদি কালের মতো এ আধুনিক কালেও কিছু মানুষের কাছে ব্যক্তির কাজ বা কল্যাণকর কথার চেয়ে তার নামটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷
জানি, ‘আশীষ চক্রবর্ত্তী’ নামটাও অনেকের খুব অপছন্দ হবে এবং সে কারণে এ লেখার নীচে কিছু মানুষ সম্প্রদায় তুলে সরাসরি বা ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করবেন৷ যারা মনের গভীরের সাম্প্রদায়িকবিদ্বেষ গোপন রেখে বিষবাষ্প ছড়াতে ভালোবাসেন, তারা হয়ত শততম বারের মতো জানতে চাইবেন, ‘‘ভারতে যে গো-মাতা রক্ষার নামে মানুষ পিটিয়ে মারা হয়, তা নিয়ে লিখেন না কেন? ফিলিস্তিনিদের কথা, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের কথা, চীনের উইগুরদের কথা লিখেন না কেন?’’
সব সময় এসব প্রশ্নের জবাব দেয়া নিষ্প্রয়োজন৷
তবে কিছু ক্ষেত্রে জবাব দেয়া জরুরি হয়ে পড়ে৷ বিদ্যানন্দ সেরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েই ‘নাম কেন বিদ্যানন্দ’ তার একটা ব্যাখ্যা গতকাল দিয়েছে৷
আজ কিশোর কুমার দাসের পদত্যাগের আসল কারণটাও জানিয়েছে তারা৷ সঙ্গে এ-ও জানিয়েছে যে, কোভিড-১৯ ক্যাম্পেইন শেষ না হওয়া পর্যন্ত চেয়ারম্যান থাকবেন কিশোর কুমার দাস৷
ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা বিভাগের সমন্বয়ক সালমান খান ইয়াসিন বলেছেন, ‘‘উগ্রবাদী কিছু সংগঠন আর ফেসবুক ইউজার কারো কারো নেগেটিভ কমেন্টে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন আমাদের চেয়ারম্যান৷ তাছাড়া কাজের এত চাপও তিনি সামলাতে পারছিলেন না৷ তিনি বলেছিলেন, সাংগঠনিক সম্পাদক পদে থেকে কাজ করবেন৷ তারপর তিনি হঠাৎ চেয়ারম্যান পদ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেও আমরা তাঁর রিজাইন লেটার অ্যাকসেপ্ট করিনি৷’’
দেরিতে হলেও সমাজের কদর্য একটা সত্যিকে স্বীকার করে ভালো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যানন্দ৷
সত্যিটা হলো, সাম্প্রদায়িকতা আমাদের সমাজে ছিল, আছে এবং এর বিরুদ্ধে সব পর্যায়ে রুখে না দাঁড়ালে তা হয়ত থাকবেও৷ তবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট না করে, সত্য আড়াল করে নিজেকে হয়ত সাময়িক প্রবোধ দেয়া যায়, কিন্তু তাতে বেশি লাভ হয় না৷
বিদ্যানন্দ নাম কারো আপত্তিকর মনে হচ্ছে দেখে যাারা অবাক, তাদের অবাক হওয়ার ক্ষমতা দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছি৷ মনে হচ্ছে চৈত্র মাসে হঠাৎ কেউ বলেছে, ‘‘কী গরম পড়েছে’’ আর তা শুনেই কেউ যেন শীতের পোশাক টপাটপ খুলতে শুরু করেছে!
আসলে এসবে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷
বাংলাদেশের নাগরিক এবং একজন সাংবাদিক হিসেবে সামান্য কয়েকটা বিষয় এই সুযোগে আবার মনে করিয়ে দিতে চাই৷
১. জমিদারের সন্তান বারীন মজুমদার কুড়িগ্রাম, পাঁচগাতি, ডোমার, চাপানি, গাইবান্ধা, উলিপুর জুড়ে ছড়ানো জমিদারি ছেড়ে লখনউ গিয়ে সংগীত শিক্ষা নিয়েছিলেন৷ সেখান থেকে ফিরে ঢাকায় সংগীত মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৬০ সালে৷ পাকিস্তান আমলে মোনায়েম খান যাকে আটকাতে পারেননি, আইয়ুব খান যাকে অনুদান এবং ‘তমঘা-এ-ইমতিয়াজ’ উপাধি দিয়েছিলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুও যাকে সম্মান-সহযোগিতা করতেন, ১৯৭৮ সালে জেলে ঢোকানো হয়েছিল তাকে৷ একসময় কারামুক্ত হলেও অপমানবোধ থেকে মুক্তি মেলেনি তার৷ অপমানের জ্বালা সইতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন৷ যার বাবার ১৮ বিঘা জমির ওপর প্রায় রাজপ্রাসাদসম বাড়ি ছিল, সেই পণ্ডিত বারীন মজুমদার এক হাজার টাকার দুঃস্থ শিল্পীর ভাতা এবং কয়েকজন অসাম্প্রদায়িক সুহৃদের আর্থিক সহায়তা নিয়ে কিছুকাল বেঁচেছিলেন বটে, কিন্তু জীবদ্দশায় জাতি তার হৃত সম্মান ফিরিয়ে দেয়নি!
(এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার রুচি এতদিন পর বারীন মজুমদারের সন্তান বাপ্পা মজুমদারের আর আছে কিনা জানি না৷)
২. বাংলাদেশে কখনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় না৷ কিন্তু তারপরও সংখ্যালঘুরা দেশ ছাড়ে৷ ১৯৭১-এর আগে ছাড়তো, পরে ছেড়েছে, এখনো ছাড়ে৷ এই বাস্তবতা কখনো বদলায়নি৷
৩. বাংলাদেশে প্রতি বছরই পূজার সময় মন্দির ভাঙা হয়৷ সংবাদ মাধ্যম তা প্রকাশ করে৷ ভাঙাভাঙি খুব বেশি বা বড় শহরে, বড় পরিসরে হয়ে গেলেই শুধু তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়৷
৪. সব দলেরই স্থানীয় পর্যায়ের কিছু নেতার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য রাখার অভিযোগ ওঠে৷ নাসির নগরে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হকের বিরুদ্ধে ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলার অভিযোগ উঠেছিল৷ এমন সমাজে সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে না পড়াই কি অস্বাভাবিক নয়?
৫. একজন সংখ্যালঘুকে প্রধান বিচারপতি করা বাংলাদেশে খুব বিরল এবং বিশেষভাগে গর্বিত হওয়ার মতো ঘটনা৷ সেই গর্ব নিয়ে আমরা সবাই রাজনীতি করতে পারি, কিন্তু গর্বটা ধরে রাখতে পারি না৷
৬. হিন্দু সম্পত্তি দখলের সুযোগ সব দলই নিয়ে থাকে৷
এই যখন পরিস্থিতি তখন কিশোর কুমার দাসের ধর্মীয় পরিচয়কে কিছু মানুষ বাঁকা দৃষ্টিতে দেখবে এটাই তো স্বাভাবিক৷
বিদ্যানন্দ তার পাশে দাঁড়িয়েছে এটাও খুব প্রত্যাশিত এবং স্বাভাবিক৷
বাংলাদেশে এমন মানুষ এখনো আছে বলেই কিশোর কুমার দাস বিদ্যানন্দ প্রতিষ্ঠা করে জীবনের সার্থকতা খোঁজেন৷
একজন মুসলিম বন্ধুর সহায়তা না পেলে তো কিশোর বহু আগে আত্মহত্যাই করতেন৷ সেই গল্প নিজেই বলেছেন একসময়৷
বিদ্যানন্দ এগিয়ে যাচ্ছে সেরকম উদার, মানবতাবাদী মানুষদের কারণেই৷
কিশোর কুমার দাসের ধর্মীয় পরিচয় কিছু মানুষের কাছে বড় হয়ে উঠেছে জেনে আমি মোটেই অবাক হইনি৷ অবাক হয়েছিলাম শত প্রতিকুলতা জয় করে যে মানুষ এমন একটা উদ্যোগে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন, তিনি কিছু মানুষ পেছন থেকে কী বলেছে তাকে গুরুত্ব দিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন জেনে৷
ভালো কাজের জন্য পদ-পদবী খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়৷
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সততা এবং আমরণ ভালো কাজ করে যাওয়ার মানসিকতা৷
বিদ্যানন্দের কিশোর-তরুণদের সেই যোগ্যতা যেন অটুট থাকে৷