বিধবা পল্লী
১ মে ২০১৫সোহাগপুরের ‘বিধবা পল্লী' আজ দেশ-বিদেশে বহু আলোচিত, সমালোচিত৷ কিন্তু এত আলোচনার সেই বিধবা পল্লীর বিধবা নারীরা কিন্তু এখনো ভালো নেই৷ ৪৪ বছরেও তাঁদরে জীবনে আসেনি সুসময়, সন্তানরাও দেখছেন না কোনো আশার আলো৷
একাত্তর সালের ২৫শে জুলাই৷ সোহাগপুরে একদিনে মোট ১৮৭ জনকে হত্যা করেছিল পাক হানাদার ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা৷ নিহতদের ৫৭ জন ছিলেন বিবাহিত, যাঁদের মধ্যে আজ বেঁচে আছেন মাত্র ৩১ জন৷ তবে তাঁদের সবাই এখন আর সোহাগপুরে থাকেন না৷ থাকতে পারেন না, কারণ থাকার মতো অবলম্বন তাদের নেই, নেই আশ্রয়৷ তাঁরা থাকেন আশপাশের গ্রামে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে৷ ৪৪ বছরেও যে কাটেনি তাঁদের উদ্বাস্তু জীবন
তাঁদেরই একজন জরিতন বেওয়া৷ জীবনের শেষ প্রান্তে নানা রোগে ভুগছেন৷ চিকিৎসার টাকা নেই, সংসার চালানোর খরচ নেই, ভাঙা ঘরে রোদ-বৃষ্টি সবই অনায়াসে ঢুকে যায়৷
জরিতন শুধু তাঁর স্বামী খেজর আলিকেই ২৫শে জুলাই হারাননি, তাঁর তরুণ ছেলে আবুল হোসেনকেও সে'দিন হত্যা করা হয়েছিল৷ ছয় সন্তানের মধ্যে পাঁচজন অবশ্য এখনও বেঁচে আছেন, কিন্তু তাঁরা যে মাকে দেখবেন, সেই সামর্থ্য নেই৷ স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও তাঁদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কোনো অবলম্বন হয়নি৷
অনেক কষ্টে ভাঙা ভাঙা শব্দে তিনি ডয়চে ভেলেকে যা বললেন, তা হলো: ‘‘বড় অভাবে আছি বাবা, বড় কষ্টে আছি৷ আমাদের দেখার কেউ নেই৷ ছেলে-মেয়ারাও তাঁদের সন্তানদের নিয়ে ভালো নেই৷ ক্ষেতে কাজ করে, রিকশা চালিয়ে কোনোরকমো সংসার চালায়, আমাকে কী দেবে!''
তিনি জানান, এখন প্রতিমাসে তাঁদের এক হাজার টাকা করে দেয় ট্রাস্ট বাংক, ব্র্যাক দেয় তিনশ' টাকা করে আর তিনি বিধবা ভাতা পান তিনশ' টাকা৷ মাসে এই একহাজার ছয়শ' টাকাই সম্বল৷
তাঁর ছেলে রিকশা চালক আসগর আলি পাশেই ছিলেন৷ দারিদ্র্যের ছাপ তাঁর চোখে-মুখে৷ তিনি বললেন, ‘‘খাবারই জোটেনা, মায়ের চিকিৎসা হবে কীভাবে?''
অপর একজন করফুলি বেওয়া একই ঘটনায় বিধবা হন তিন শিশু সন্তান নিয়ে৷ ৪৪ বছর আগে বিধবা হওয়ার পর তাঁর জীবনে তখন নেমে আসে কষ্ট আর যন্ত্রণা৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, কচু, শাক-পাতা আর ভাতের মাড় খেয়ে জীবন কেটেছে৷ বছরের পর বছর থালা ভরা ভাত চোখে দেখেননি৷ দুই কাঠা জমি ছিল তাও চাষ করতে পারতেন না৷ ধানের কলে কাজ করতেন তাতেও অভাব কাটত না৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমার ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছ কচু-ঘেচু খেয়ে৷ পরে একটু বড় হওয়ার পর তাদেরকেও ক্ষেতের ধান টোকাত, পেটে-ভাতে বদলি শ্রমিকের কাজে লাগানো হয়েছে৷ তাই তারা রয়ে গেছে নিরক্ষর৷ অবস্থা আজও পাল্টায়নি৷ ছেলে কফিল এখন অন্যের ক্ষেতে কাজ করে আর দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেও তাদের ঘরেও চরম অনটন৷''
করফুলি বলেন, ‘‘স্বামী হারিয়েছি, আমার জীবনও হারিয়ে গেছে৷ এখনো একইভাবে দারিদ্র্যই আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে৷ ভবিষ্যৎ কী হবে জানি না৷''
সোহাগপুরে এখনো আছেন বিধবা হাফিজা, মাহিনুর, হাজেরা, মালতি, লাকজান, মহিরন,করিমন, নুরেমান, ওজুবা, সমলাসহ আরো কয়েকজন, যাঁদের স্বামী একই দিনে শহিদ হয়েছেন৷তাঁদের সবার জীবনের গল্প একই রকম, যা কিনা গত ৪৪ বছরেও বদলায়নি৷ সময় কেটেছে, আলোচনা হয়েছে, বিচার হয়েছে ঘাতকের৷ কিন্তু এঁদের জীবনে আসেনি তেমন কোনো দিন বদালানোর গল্প৷
স্থানীয় সাংবাদিক এবং গবেষক এম এ হাকাম হীরা ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এই শহিদ জায়া, বিধবাদের জন্য এখন শুধু ট্রাস্ট ব্যাংক, ব্র্যাক আর সরকারের বিধবা ভাতাই আছে৷ সব মিলিয়ে তাঁরা প্রত্যেকে মাসে পান এক হাজার ছয়শ' টাকা৷ নুরেমান বেওয়া যোগ করেন, ‘‘একবার মতিয়া চৌধুরী আমাদের প্রত্যেককে দু'টি করে ছাগল দিয়েছিলেন৷''
সরকারের কোনো সহযোগিতা? শহিদ পরিবারের সরকারি ভাতা? এ সব প্রশ্নের জবাবে তাঁরা একযোগে জানান, ‘‘আমরা যে শহিদ পরিবার তার কোনো স্বীকৃতিই নেই৷ ভাতা তো দূরের কথা৷ আর এই সরকার চলে গেলে যেটুকু পাই, তাও বন্ধ হয়ে যাবে৷''
মাহিনুর বেওয়া অনেক আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবরের চিঠিই আমাদের বড় স্বীকৃতি৷ তাঁর মেয়ে এখন প্রধানমন্ত্রী, তিনি নিশ্চয়ই আমাদের জন্য কিছু করবে – সেই আশাতেই আছি৷''
বিধবা পল্লীতে একটি সংগঠন আছে৷ নাম শহিদ পরিবার কল্যাণ সমিতি৷ এর সভাপতি শহিদ সন্তান জালাল উদ্দিন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘৫৭ জন নারী বিধবা হওয়ার সঙ্গে কতপক্ষে দেড়শ' সন্তান তাঁদের বাবাকে হারান৷ তাঁদের জীবনেও তখন নেমে আসে অবহেলা, দারিদ্র্য আর কষ্ট৷ সেই দারিদ্র্য কিন্তু এখনো কাটেনি৷''
তিনি জানান, ‘‘এই গ্রামে কোনো শিক্ষিত লোক নাই৷ শহিদদের সন্তানরা কেউই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারেননি৷ তাঁদের কেউ কেউ এখন রিকশাচালক, কেউ মজুর আবার কেউ বা অন্যের জমিতে কাজ করেন৷ আমি নিজেও বদলি শ্রমিকের কাজ করি৷''
‘‘আমরা একবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই৷ তাঁকে বিধবা পল্লীর কষ্টের কথা জানাতে চাই৷'', জানান জালাল উদ্দিন৷