বিভক্তির দেয়াল দেখতে চায় না তরুণ প্রজন্ম
১৬ ডিসেম্বর ২০২১বাংলাদেশে শাহবাগ এবং শাপলা চত্বরে তরুণদের মধ্যে যে দুই ধারা তা অস্বীকার করছেন না কেউই। তবে এর জন্য তারা দায় দিচ্ছেন যারা বিভিন্ন সময় স্বাধীনতার পর দেশ শাসন করেছেন তাদের ওপর। তারা মনে করেন সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি। শাসক গোষ্ঠী নিজেদের মত করে ইতিহাস রচনা করেছে। ফলে ইতিহাস নিয়ে নতুনেরা বার বার বিভ্রান্তিতে পড়েছে। এটাই দেয়াল তৈরির মূলে কাজ করেছে নতুন প্রজন্মের মধ্যে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও আছে স্বার্থের নানা ধরনের বিভক্তি। জাতীয় বিষয়গুলোতেও ঐকমত্যের অভাব প্রকট।
ঢাকার যাত্রাবাড়ি মাদ্রাসার ছাত্র মীর হাবিব আল মানজুর বলেন,"আমরা শাহবাগ আর শাপলা চত্বরে তরুণদের মধ্যে যে বিভক্তি দেখেছি তা হওয়ার কথা ছিল না, তবে ২০১৩ সালের পর এটা কমে এসেছে। কারণ তরুণদের মধ্যে ইন্টারঅ্যাকশন বেড়েছে। আমরা যে ব্যাকগ্রাউন্ডেরই হইনা কেন এখন আমরা পরস্পরকে বুঝতে চেষ্টা করছি। আমরা নানা মতের ভিন্নতাও অনুধাবন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এটা আরো অনেক আগে থেকেই হওয়া দরকার ছিলো। তাহলে জাতির মধ্যে যে বিভক্তি তা কমে আসত।”
স্বাধীনতার ৫০ বছরে তার উপলব্ধি,"আমরা বড় পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে এখনো ছোট ছোট পরাধীনতার মধ্যে আছি। এখানে ভোটের অধিকার, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বাকস্বাধীনতা এখনো নিশ্চিত হয়নি। এগুলো নিশ্চিত হলেই আমরা প্রকৃত স্বাধীন হবো। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের পরস্পরের প্রতি দরদী হতে হবে। পরষ্পরের প্রতি সম্মান বোধ থাকতে হবে।”
সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র মামুন সোহাগ মনে করেন,"দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দেশ তথ্য প্রযুক্তিতে এগোচ্ছে সেটাও ভালো। কিন্তু দেশের ভিতরে বড় একটি বিভেদের দেয়াল দেখতে পাচ্ছি। তরুণেরা যেন এখন রাজনীতির শিকারে পরিণত হচ্ছে। তাদেরও ভাগ করে ফেলা হচ্ছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, বইয়ে পড়েছি। জেনেছি তরুণেরাই প্রধানত মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। দেশ স্বাধীন করেছেন যে তরুণেরা তারাই তো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু তাদের সঠিক পথ দেখাতে হবে। দেয়াল রাখা চলবে না। রাজনৈতিক বিভক্তি কাউকে শাহবাগে কাউকে শাপলা চত্বরে নিচ্ছে। এর জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাও দায়ী। তরুণদের বিভক্ত না করে তাদের ঐক্যবদ্ধ করে দেশের উন্নয়নে লাগাতে হবে।”
অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও সামাজিক বৈষম্য এবং রাজনীতিতে আদর্শহীন স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখতে পাচ্ছেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষার্থী মারজুক রায়না। তার কথা,"এখানে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বা বিরোধিতা আদর্শিক নয়। স্বার্থের জন্য। তার প্রভাব পড়ছে তরুণদের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিলো তা হয়নি। আমরা এখনো একটা জাতি হতে পারিনি। ধর্মের ভিত্তিতে ছোট ছোট জাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ছি।”
তিনি আরো বলেন,"দুর্নীতি, অর্থপাচার বেড়েছে। যারা ক্ষমতাবান তাদের হাতে সব কিছু চলে যাচ্ছে। স্বাধীনতার চেতনা এটা নয়।” একজন তরুণ হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যের বাংলাদেশ দেখতে চান।
তার কথা," মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সেই বাংলাদেশ তরুণেরাই গড়তে পারবে। তাই বিভক্ত করার সব অপচেষ্টা রোধ করা দরকার। শিক্ষায় তার প্রতিফলন থাকতে হবে। থাকতে হবে রাষ্ট্র ব্যবস্থায়।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুকাইয়া জহির মনে করেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার নারী হলেই নারীরা ভালো আছেন সেই উপসংহারে যাওয়া যায় না। দেশের সাধারণ নারীরা কেমন আছেন সেটাই বড় প্রশ্ন। তার কথা,"সাধারণ পর্যায়ে তো দূরের কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এখনো নির্যাতন, হত্যার শিকার হচ্ছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে, কমেনি। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে।” তার অভিমত দেশের উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে,"সুশাসন, মানবাধিকার, ন্যায় বিচার এগুলো জরুরি। সবচেয়ে দরকার সামাজিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার। আর প্রয়োজন স্বার্থের বিভক্তি দূর করা। আমরা একটি বিভক্তিহীন রাষ্ট্র দেখতে চাই।”
তিতুমীর কলেজের আরেকজন শিক্ষার্থী আল ইমরান মনে করেন. স্বাধীনতার এই ৫০ বছরেও তরুণদের একাংশের মধ্যে স্বাধীনতার গুরত্ব নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। চিন্তায় পার্থক্য আছে। জানাশোনায় পক্ষপাতিত্ব আছে। ফলে কারো কারো কাছে হয়তো মনে হচ্ছে এটা গুরুত্বহীন। তবে তার কথা, "এই দায় তরুণদের দিলে চলবে না। যাদের দায়িত্ব ছিলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরা, তরুণদের মাঝে সঞ্চারিত করা তারা তা করেননি। তারা ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। আর বাক স্বাধীনতাও সংকুচিত হয়ে পড়ছে।”
তারপরও ইমরান মনে করেন," বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে অনেক সংকট নিয়েও। একদিন হয়তো বিশ্বে রোল মডেলও হবে। আর সেটা হবে তরুণদের হাত ধরেই।”