কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানমের নেতত্বাধীন বেঞ্চের নির্দেশ ছিল, শেখ শাহজাহানকে মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটের মধ্যে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিতে হবে। কারণ, সন্দেশখালি নিয়ে পুলিশ বা তাদের বিশেষ তদন্তকারী দল নয়, সিবিআই তদন্ত করবে।
এরপর তিনটে ৪০ মিনিট নাগাদ সিবিআইয়ের একটি দল শেখ শাহজাহানকে তাদের হেফাজতে নেয়ার জন্য ভবানী ভবনে পৌঁছে যায়। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরাও সেখানে ছিলেন। আড়াই ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করার পর তারা ফিরে যান। তাদের হাতে শেখ শাহজাহানকে তুলে দেয়নি সিআইডি। সিবিআই দলকে জানানো হয়, শেখ শাহজাহানকে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানানো হয়েছে। তার ফয়সালা না হলে তাকে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয়া হবে না।
সুপ্রিম কোর্টে শেখ শাহজাহানকে সিবিআইয়ের হাতে তুলে না দেয়ার আবেদন নিয়ে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী অভিষেক মণু সিংভি। তিনি শুধু সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীই নন, বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতাও। তিনি কেন্দ্রীয় স্তরে কংগ্রেসের মুখপাত্র। গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ। কয়েকদিন আগেই তিনি হিমাচল প্রদেশে রাজ্যসভা নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী ছিলেন। সেই ভোটে তিনি হেরেছেন। এর আগে তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে তণমূলের সমর্থনে রাজ্যসভার সদস্য হয়েছিলেন। সেই অনুমতিও দল তাকে দিয়েছিল।
সিংভি-র আবেদন খারিজ করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের জানিয়েছে, তাকে নিয়মমাফিক রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে আবেদন করতে হবে।
এবার সেই পদ্ধতির মধ্যে গিয়ে আবেদন জানাবেন সিংভি। সেটা আইনগত বিষয়। কিন্তু সিংভির এভাবে শেখ শাহজাহান ও রাজ্য পুলিশের পক্ষে সর্বোচ্চ আদালতে আইনজীবী হিসাবে দাঁড়ানোর পর আবার সেই পুরনো প্রশ্নটা নতুন করে খুব জোরালোভাবে উঠছে। তাহলে কি এই আইনজীবী-রাজনীতিকদের দলের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতাই নেই? দিনের পর দিন তারা দলের অবস্থানের উল্টো মেরুতে গিয়ে আদালতে আবেদন করবেন, তাতে দলের রাজনৈতিক ক্ষতি হবে, রাজ্য নেতারা বিপাকে পড়বেন, তারপরেও তারা পেশার স্বার্থের কথা বলবেন, এইভাবে দুই নৌকায় পা দিয়ে তারা কতদিন চলবেন?
সবচেয়ে বড় কথা, এই ক্রমশ তলানিতে চলে যাওয়া কংগ্রেসের জাতীয় স্তরের নেতারা আর কতদিন এই কাজ বরদাস্ত করবেন? রাজ্য নেতারা অভিযোগ জানাবার পরেও তো তারা সিংভিদের নিরস্ত করেন না। চুপ করে বসে থাকেন। বিজেপি-তেও তো আইনজীবী নেতার সংখ্যা কম নয়। তাদের কারো সাধ্য হবে, দলের নীতির বাইরে গিয়ে শেখ শাহজাহানের বা রাজ্য সরকারের পক্ষ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানানোর? হবে না। রাজনীতি করতে গেলে দলের স্বার্থে এই ন্যূনতম স্বার্থত্যাগ তো করতেই হয়।
দল তো তাদের কম দিচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে তাদের রাজ্যসভায় জিতিয়ে এনেছে। সম্মান দিয়েছে। প্রধান মুখপাত্র করেছে। নির্বাচনী কাজের দায়িত্ব দিয়েছে। এমনও নয়, এই মামলাগুলি না করলে তাদের রোজগার ভয়ংকরভাবে কমে যাবে। সিংভিরা সকলেই খ্যাতনামা আইনজীবী। সুপ্রিম কোর্টে একবার কোনো মামলায় দাঁড়ালেই প্রতিদিন তারা লাখ লাখ টাকা পান। ফলে একটা-দুটো মামলা না করলে তাদের কিছুই যাবে আসবে না।
প্রশ্নটা হলো নৈতিকতার, এখানে পেশাগত স্বাধীনতার প্রশ্ন অত গুরুত্বপূর্ণ নয়। এবার একটু ২০২২ সালের ৪ মে-র দিকে নজর ফেরানো যাক। কংগ্রেসের আরেক আইনজীবী সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী পি চিদম্বরম কলকাতায় এসেছিলেন রাজ্য সরকারের হয়ে একটি মামলা করতে। মেট্রো ডেয়ারি নিয়ে সেই মামলা করেছিলেন অধীররঞ্জন চৌধুরী। সেই মামলায় অধীরের বিপক্ষে ও রাজ্য সরকারের পক্ষে সওয়াল করতে কলকাতায় আসেন চিদম্বরম। সেই সময় আদালতকক্ষ থেকে বেরোনোর পরেই কংগ্রেসের আইনজীবী নেতা কৌস্তব বাগচীর নেতৃত্বে একাধিক আইনজীবী চিদম্বরমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখান। সেই সময় কৌস্তভ বলেছিলেন, "চিদম্বরম তৃণমুলের হয়ে দালালি করতে এসেছিলেন। তারই প্রতিবাদ করা হয়েছে। আইনজীবী হিসেবে নয়, কংগ্রেসের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে এই প্রতিবাদ করেছি। এরকম কাজ অন্য কেউ করলে তাদের জন্য জুতোর মালা, কালো পতাকা ও গো ব্যাক স্লোগান অপেক্ষা করবে।”
ঘটনা হলো, কিছুদিন আগেই কৌস্তভ বেহাল কংগ্রেস থেকে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন। সেই সময় অধীররঞ্জন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বলেছিলেন, এরকম কাজ যেন আইনজীবী নেতারা না করেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! অধীর-সহ কংগ্রেস নেতারা দিনের পর দিন শাহজাহান নিয়ে, সন্দেশখালি নিয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, মিছিল করবেন, আর দিল্লিতে তাদের নেতাই শাহজাহান ও রাজ্য সরকারের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করবেন। এরপর তণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে?
মঙ্গলবার সাবেক বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন তিনি বিজেপি-তে যোগ দিচ্ছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছেন, বিজেপি-ই একমাত্র জাতীয় দল যারা রাজ্যে তণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তাই তিনি বিজেপি-কে বেছে নিয়েছেন। কংগ্রেস সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ওটা তো একটা রাজনৈতিক জমিদারি, পারিবারিক জমিদারির দল। সেই দলে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
কোনো সন্দেহ নেই, এখনো কংগ্রেসে নেহরু-গান্ধী পরিবারের সদস্যদের কথাই শেষ কথা। তারা অভিষেকদের এই ধরনের কাজে কোনো বাধা দেননি, এখনো দিচ্ছেন না। ফলে দল রসাতলে গেলেও, দেশের মানুষের মনে বিরূপ মনোভাব দেখা দিলেও তারা কিছুই করছেন না। হয়ত, মামলা-জর্জরিত কংগ্রেসের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে লড়াই করার জন্য অভিষেকরাই তাদের ভরসা। তাই তাদের কিছু বলা হয় না।
কিন্তু এভাবে পশ্চিমবঙ্গে দলের যেটুকু সমর্থন ছিল, তা-ও যাবে। আব্দুল মান্নানের মতো প্রবীণ নেতা বসে গেছেন। তার অভিযোগ, সমানে অবহেলিত হওয়ার পর শীর্ষ নেতত্বকে নালিশ করার পরও কেউ কোনো কথা শোনে না। সংখ্যালঘু ভোট যে চলে যাচ্ছে সে সম্পর্কে অনেকদিন আগে সতর্ক করে দিয়েছিলেন মান্নান। তার কথা শোনা হয়নি। তৃণমূলের সঙ্গে জোটের প্রবল বিরোধী মান্নানও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। শীর্ষ নেতৃত্ব খবরও নেয়নি। অথচ, এই মান্নানই দলত্যাগ করার যাবতীয় প্রলোভন সত্ত্বেও কংগ্রেসে থেকে গেছেন।
আর রাহুল গান্ধীরা কি করছেন? এখনো পর্যন্ত একবারের জন্যও তিনি সন্দেশখালি নিয়ে মুখ খোলেননি। তণমূল নেতৃত্বের সমালোচনা করেননি। বরং তৃণমূল মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পরেও তাদের সঙ্গে জোট করার চেষ্টা করেছেন। বিরোধিতা করতে গেলে সর্বাত্মক বিরোধিতা করতে হয়। কলকাতায় রাজ্য নেতারা কুস্তি করবেন, আর দিল্লিতে কেন্দ্রীয় নেতারা দোস্তির চেষ্টা করবেন, এই নীতি নিয়ে কতদিন আর চলা যায়!
ফলে পশ্চিমবঙ্গে এই কংগ্রেসের ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। এক-দুইটি আসন পেলে যথেষ্ট। আর রাজ্য নেতারা একরকম বলবেন, সন্দেশখালির সমালোচনা করবেন, লড়াইয়ের কথা বলবেন, আর তাদের নেতা সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের হয়ে সন্দেশখালি নিয়ে সওয়াল করবেন, এটা দেখার পর জনতা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে সেটা কি খুব অন্যায় হবে। পশ্চিমবঙ্গে তো কংগ্রেস ও তৃণমূল এমন কাজ করছে, যাতে বিজেপি রাজনৈতিক সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। যা দেখা যাচ্ছে, তাতে তারাই নিজেদের কাজের মাধ্যমে বিজেপি-কে খোলা মাঠ ছেড়ে দিচ্ছে। কৌস্তভের মতো অন্য কংগ্রেস নেতারাও বিজেপি-র দিকে পা বাড়ালে কি নৈতিকভাবে কিছু বলার জায়গায় থাকবে কংগ্রেস হাইকম্য়ান্ড? তারা তো স্বখাত সলিলে ডুবে মরছেন।