বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে মাতামাতি
১৬ নভেম্বর ২০২২আরো কয়েকটি দলের সমর্থক বাংলাদেশে থাকলেও দাদের সংখ্যা বেশি না। মূলত ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাকে ঘিরে পুরো দেশ দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শুধু নিজ দলকে সমর্থন না, প্রতিপক্ষে দলের সাপোর্টারদের কিভাবে ঘায়েল করা যায় সেটাও এক ধরনের প্রতিযোগিতায় রূপ নেয়। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।
তবে এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। পূর্বের বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় দেখা গেছে সমর্থকরা অনেক আগে থেকেই মাঠে নেমে পড়ে। মিডিয়াতেও কাউন্টডাউন শুরু হয়, নানা ধরনের প্রতিবেদন ছাপতে দেখা যায় মাসখানেক আগে থেকেই। এবার এতে কিছুটা ঘাটতি দেখা গেছে।
এর অন্যতম কারণ সদ্য সমাপ্ত টি২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেট। গত সপ্তাহ পর্যন্ত দেশের মানুষ ক্রিকেট নিয়ে মেতে ছিল। ফলে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশে ‘হাইপ' বা মাতামাতি দেরিতে শুরু হয়।
দেশে চলমান রাজনৈতিক উত্তাপও এর জন্য কিছুটা দায়ী। এছাড়াও বিশ্বকাপ ফুটবল সাধারণত বছরের মাঝামাঝি আয়োজন করা হয়। এবার তা হচ্ছে বছরের শেষভাগে। এই সময় বা শীতকালে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বেশি থাকে। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে উত্তেজনা দেরিতে ছড়ানোর এটিও অন্যতম কারণ।
এরই মধ্যে ভারতের ক্রিকেট দল বাংলাদেশে আসছে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। ফুটবল বিশ্বকাপের মাঝে বাংলাদেশ ও ভারত তিন ওয়ানডে ও দুই টেস্টের সিরিজ খেলবে। এটা ফুটবল বিশ্বকাপকে কিছুটা হলেও ব্যাহত করবে।
বিশ্বকাপ শুরুর আর মাত্র তিন দিন বাকি। দেরিতে হলেও চার বছর পর বিশ্বকাপের খেলাগুলো উপভোগ করার জন্য দেশের মানুষ প্রস্তুত। অনেকেই ইতিমধ্যে নিজ দলের জার্সি ও পতাকা সংগ্রহ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে অনেক ধরনের আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ। অনেক ধরনের হিসাব কষছেন তারা। আর এসবের কেন্দ্রে রয়েছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। বর্তমান শিরোপাধারী ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়ামকে নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।
বিশ্বকাপের প্রচারে আগের মতো কলেবর না থাকলেও মিডিয়াগুলো বিশেষ ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছে, যেখানে সব দলকে নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোন দলের সম্ভাবনা কতটুকু ছাড়াও খেলোয়াড়দের নিয়েও আছে বিশ্লেষণ। রাজনৈতিক খবরের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমে বিশ্বকাপের খবর গুরুত্বের সাথে ছাপা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ফুটবলের দর্শক মূলত দুই ধরনের। এক ধরনের দর্শক হলো শহরকেন্দ্রিক, যারা প্রায় বছর জুড়ে ইউরোপের লীগ দেখে, দুবছর অন্তর কোপাও দেখে অনেকে। এরা অনেক খোঁজখবর রাখে ফুটবলের। অনেক খেলোয়াড়কেও তারা চেনে। আরেক ধরনের দর্শক হলো বিশ্বকাপকেন্দ্রিক। এদের সংখ্যা বেশি গ্রামে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সারা বছর ফুটবল খেলা না দেখলেও বিশ্বকাপকে ঘিরে চার বছর পর গ্রামের মানুষের মাঝে এক ধরনের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে।
যেমন কুড়িগ্রামের কোনো গ্রামের মানুষ সারা বছর কোনো ফুটবল খেলা না দেখলেও বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলাগুলো তারা দেখে থাকে।
গ্রামাঞ্চলে প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে নিজ দলের শুভকামনা করে মিলাদ, এমনকি দল জিতলে গরু-খাসি জবাই করে উৎসব করে। এবার তার ব্যাতিক্রম হবে না।
আরেক ধরনের প্রতিযোগিতা হয় তাদের মাঝে, সেটা হলো কে কত বড় পতাকা বানাতে পারে। নিজ নিজ বাড়ির ছাদে পতাকা টাঙিয়ে জানান দেয়া হয় কে, কোন দলের সমর্থক। বাংলাদেশের রাস্তা, বাড়ি ও মাঠে-ঘাট এখন বিভিন্ন দেশের পতাকায় ছেয়ে গেছে।
এছাড়াও বিভিন্ন দলের সাপোর্টাররা ফেসবুকে নতুন নুতন গ্রুপ খুলে তাদের দলের পক্ষে প্রচার-প্রচারনায় নেমে পড়েছে।
বাংলাদেশে ফুটবলের সমর্থকের বেলায় আরেকটি ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো। প্রতিটি বিশ্বকাপের আগে তারা কিছু হিরো বানায়, যাদের নিয়ে বেশি আলোচনা-মাতামাতি হয়। এই তালিকায় গতবারের মতো এবারও রয়েছে আর্জেন্টিনার মেসি ও ব্রাজিলের নেইমার। মজার বিষয় হলো, এই দুই খেলোয়াড়ের বাইরে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ অন্য খেলোয়াড়দের তেমন চেনে না।
গত এক দশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ক্রিকেট বিস্তার লাভ করার কারণে ক্রিকেটপ্রেমীদের সংখ্যা বেড়েছে। তবে এর ফলে বিশ্বকাপ ফুটবলের জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি। আগামী রবিবার উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক কাতার লড়বে ইকুয়েডরের সাথে।
তবে বাংলাদেশে বিশ্বকাপের মুল উত্তেজনা শুরু হবে ২২ নভেম্বর। সেদিন আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হবে সৌদি আরবের। আর্জেন্টিনার সমর্থকরা ছাড়াও তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের সমর্থকরা মনযোগ দিয়ে খেলা দেখবে। খেলার ফলাফল যা-ই হোক তারা মেতে উঠবে বিচার-বিশ্লেষণ, আলোচনা-সমালোচনায়। আর যত দিন গড়াবে, এই মাতামাতি বাড়তেই থাকবে।