বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পলোনিয়ামের আদ্যপ্রান্ত
৯ জুলাই ২০১২আরাফাতের বিধবা স্ত্রী সম্প্রতি তাঁর স্বামীর মৃতদেহ কবর থেকে তুলে তা পরীক্ষার দাবি জানিয়েছেন৷ কারণ ২০০৪ সালে মারা যাওয়ার আগে তিনি যে কাপড় পরেছিলেন, সেই কাপড়ে পাওয়া গেছে পলোনিয়াম ২১০ নামক তেজস্ক্রিয় পদার্থের অস্তিত্ব৷ সুইজারল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা আরাফাতের কাপড়ে এই বিষাক্ত পদার্থের খোঁজ পান৷ ফলে এই পলোনিয়াম নিয়ে সারাবিশ্বে আলোচনার ঝড় উঠেছে নতুন করে৷
পলোনিয়াম কী?
পলোনিয়াম ২১০ বিশ্বের বিরলতম পদার্থগুলোর একটি৷ ১৮৯৮ সালে বিজ্ঞানী দম্পতি মেরি ও পিয়েরে কুরি এই পদার্থটি আবিষ্কার করেন৷ এই বিজ্ঞানীদ্বয়ের দেশ পোল্যান্ডের নাম অনুসারে সেই পদার্থের নাম রাখা হয় পলোনিয়াম৷ ভূপৃষ্ঠের শক্ত আবরণে খুব নিম্ন ঘনত্বে প্রাকৃতিকভাবেই এই পদার্থের সৃষ্টি হতে পারে৷ তবে পারমাণবিক চুল্লিতেও কৃত্রিমভাবে এটির উৎপাদন সম্ভব৷ শিল্প-কারখানায় যন্ত্রপাতি স্থির বিদ্যুৎমুক্ত করতে অল্প পরিমাণে এই পদার্থটি ব্যবহার করা হয়৷
এটা কি বিপদজনক?
পলোনিয়াম অত্যন্ত বিপদজনক৷ খুব সামান্য পরিমাণেও যদি মানুষের দেহে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তাহলেও মৃত্যু ডেকে আনতে পারে৷ পদার্থটির মাত্র এক গ্রাম ধুসর গুড়াতেই মানুষ মারা যাবে৷ ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংস্থার তেজস্ক্রিয়তা বিশেষজ্ঞদের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, একবার যদি রক্তের সাথে পলোনিয়াম ২১০ মিশে যায়, তাহলে এর ক্রিয়া থামানো প্রায় অসম্ভব৷ কারণ এটির আলফা তেজস্ক্রিয় উপাদান যকৃত, বৃক্ক এবং অস্থিমজ্জার উপর বিষক্রিয়া ঘটিয়ে একাধিক অঙ্গ বিকল করে দেয়৷ ২০০৬ সালে পলোনিয়ামের বিষক্রিয়ায় নিহত লিটভিনেঙ্কোর ক্ষেত্রে বমিবমিভাব, চুল উঠে যাওয়া, গলা ফোলা এবং বিবর্ণ হয়ে যাওয়ার লক্ষণগুলো ধরা পড়েছিল৷
এটি কাদের হাতে থাকতে পারে?
সুখের খবর হলো যে, খুব বেশি মানুষের পক্ষে এই বিষাক্ত পদার্থটি পাওয়া সম্ভব নয়৷ কারণ ইউরেনিয়াম প্রক্রিয়াজাতকরণের রাসায়নিক উপজাত হিসেবে এটি পাওয়া যায়৷ এছাড়া পারমাণবিক চুল্লিতে এটি কৃত্রিমভাবে উৎপাদন করা হয়৷ আর এই পারমাণবিক স্থাপনাগুলো আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রিত৷
হন্তাদের কাছে এটি লোভনীয় কেন?
পলোনিয়াম দিয়ে ভালো অস্ত্র বানানো যায়৷ এটির আলফা তেজস্ক্রিয় উপাদান ত্বক ভেদ করে না এবং তেজস্ক্রিয় নির্ণয়কারী যন্ত্রেও ধরা পড়ে না৷ ফলে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এটি অন্য দেশে পাচার করা সহজ৷ নিশ্বাসের সাথে অথবা ক্ষতস্থান দিয়ে কারো দেহে পলোনিয়াম ঢুকিয়ে দেওয়া যায়৷ তবে সবচেয়ে নিশ্চিত উপায় হলো খাবার কিংবা পানির সাথে মিশিয়ে দেওয়া৷ লিটভিনেঙ্কো লন্ডনের একটি বিলাসবহুল হোটেলে বৈঠক করার সময় পলোনিয়াম মেশানো চা পান করেছিলেন৷
পলোনিয়াম দিয়ে কাদের মারা হয়েছে?
পলোনিয়াম দিয়ে কাউকে মারার ঘটনা এতোটাই বিরল যে, লিটভিনেঙ্কোর দেহে এর বিষক্রিয়া নির্ণয় করতে চিকিৎসকদের বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় লেগেছিল৷ লিটভিনেঙ্কো খুনের পর পাঁচ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও কেউ আটক হয়নি৷ ব্রিটিশ কৌঁসুলিরা এই খুনের জন্য সাবেক কেজিবি গোয়েন্দা আঁন্দ্রে লুগোভোই'কে তাদের সন্দেহের তালিকায় শীর্ষে রাখলেও রাশিয়া তাঁকে হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে৷
পলোনিয়ামের আবিষ্কর্তা কুরি দম্পতির মেয়ে ইরিন লিউকেমিয়ায় মারা গিয়েছিল বলেই বিশ্ব জানে৷ তবে অনেকে সন্দেহ করেন যে, তাদের পরীক্ষাগার থেকে দুর্ঘটনাবশত কোনভাবে পলোনিয়াম ইরিনের দেহে প্রবেশ করে থাকতে পারে৷ এছাড়া ইসরায়েলি লেখক মিশাল কার্পিন দাবি করেছেন যে, ১৯৫৭ সালে ভাইজসমান বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানে ছিদ্র দিয়ে রাসায়নিক পদার্থ বেরিয়ে যাওয়ার কারণেই সেখানকার বেশ কিছু বিজ্ঞানী মারা যান৷ তবে ইসরায়েল এমন কথা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে৷
আরাফাতের ক্ষেত্রে পলোনিয়ামের বিষক্রিয়ার বিষয়টি কি এখন প্রমাণ করা যাবে?
কিছু বিজ্ঞানী মনে করছেন, আরাফাতের পোশাকে পলোনিয়ামের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াটা বিষক্রিয়ার যথেষ্ট প্রমাণ নয়৷ বরং তাঁর দেহ কবর থেকে তুলে পরীক্ষা করলে অনেক বেশি নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে৷ ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এর তেজস্ক্রিয়বিদ্যার অধ্যাপক ডেরেক হিল মনে করেন, ২০০৪ সালে আরাফাতের মৃত্যুর আট বছর পর তাঁর দেহে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা খুব লঘু হয়ে যেতে পারে৷ তবুও এখন নতুন করে তাঁর ময়না তদন্ত করা হলে ‘এটি অনেক বেশি নিশ্চিত' হওয়া যাবে যে, আরাফাতকে পলোনিয়ামের বিষক্রিয়ায় মারা হয়েছিল কিনা৷
এএইচ / জেডএইচ (এপি)