বিহারে দাঙ্গা, পশ্চিমবঙ্গে আঁচ
২৯ মার্চ ২০১৮ভারতে আবারও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷ এবার জ্বলছে বিহার৷ মূলত রাম নবমী পালনকে কেন্দ্র করে কার্যত জ্বলে উঠেছে বিহারের একাংশ৷ দাঙ্গার কবলে বিহারের ভাগলপুর, ঔরঙ্গাবাদ, মুঙ্গের, নালন্দা, শেখপুরা এবং জামুই৷ গত কয়েকদিন ধরে বহু পুলিশকর্মীসহ কয়েকশ' মানুষ গুরুতর জখম হয়েছেন৷ সন্ত্রাসের কবলে বহু যানবাহন এবং বাড়ি-ঘর পুড়ে ছাই৷
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে নাজেহাল হতে হচ্ছে র্যাপিড অ্যাকশান ফোর্স ও বিপুল পুলিশবাহিনীকে৷ রামনবমী পালনকে ঘিরে দাঙ্গা পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের একাংশেও৷ সরকার ও পুলিশ কড়া হাতে দমনের চেষ্টা চালাচ্ছে৷ কিন্তু, ভারতের মতো দেশে বরাবরই হিংসা ছড়ানোর পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থ মিশে থাকে৷ এবারও সেই চেষ্টায় খামতি নেই৷
তবে, এবার সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেনা ছক ততটা সফল হয়নি৷ মমতা ব্যানার্জির সরকারের অবস্থান বেশ স্পষ্ট—ধর্মীয় সুড়সুড়ি দেওয়া হলে রেহাই পাবেন না কেউই৷ রাজনৈতিকভাবে ঘোর বিজেপিবিরোধী তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস৷ চরম হিন্দুত্বে মদত নেই৷ অন্যদিকে, বিহারে বেঁকে বসেছে ভারতীয় জনতা পার্টিরই বর্তমান জোটসঙ্গী জনতা দল ইউনাইটেড৷ কারণ, বিহারে ‘রামরাজ্য' স্থাপন তো দূর, আপাতত প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখাও সম্ভব হচ্ছে না৷
সূত্রপাত দিনকয়েক আগে একটি বিসর্জনের শোভাযাত্রায় জুতো ছোঁড়ার ঘটনায়৷ পাল্টা পাথর ছোঁড়া হয় মসজিদে৷ এ পর্যন্ত কয়েকশ' মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তবে, প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ স্থানীয় ভারতীয় জনতা পার্টি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে৷ ভারতীয় জনতা পার্টির নেতাদের উস্কানিমূলক ভাষণের জেরেই দাঙ্গা চড়িয়েছে বলে অভিযোগ৷
ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিহারের এক টিভি চ্যানেলের প্রবীণ সাংবাদিক কুন্দন সিং বলেছেন, ‘‘মন্ত্রীর ছেলের উস্কানিমূলক ভাষণের পর থেকেই হিংসা শুরু হয়েছিল৷ তারপর রামনবমীর পদযাত্রার ফলে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়েছে৷ মোট ছ'টি জেলার অবস্থা শোচনীয়৷ অন্যদিকে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, রাজনৈতিক কারণে আইন-শৃঙ্খলা নষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে৷ ছ'টি জেলাতেই ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গের রানীগঞ্জ ও আসানসোল লাগোয়া অঞ্চলে পরিস্থিতি ক্রমশই খারাপ হচ্ছে৷''
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছে বিরোধীরা৷ রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতা, তথা বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব ভাগলপুরে দাঙ্গায় উস্কানির অভিযোগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী চৌবের ছেলে অরিজিৎ শাশ্বত চৌবেকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন৷ শাশ্বতের বিরুদ্ধে অনুমতি ছাড়া অস্ত্রসহ মিছিল ও সভা করার অভিযোগে মামলা হয়েছে৷ বৃহস্পতিবার সমস্তিপুরে দীনেশ ঝা ও মোহন পাটবা-সহ মোট ১০ জন বিজেপি নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
পুলিশ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, ১৭ মার্চ ভাগলপুর শহরে ‘ভারতীয় নববর্ষ জাগরণ সমিতি' নামে এক সংগঠনের মোটরবাইক মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন শাশ্বত৷ তবে ওই মিছিলের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল প্রাক্ নববর্ষ উদযাপনের নামে৷ কিন্তু যখনই মিছিল কোনও মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল, তখনই প্ররোচনামূলক স্লোগান দেওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ৷ শেষে গন্ডগোল বাঁধে নাথনগর থানা এলাকার মেদিনী চকে৷ মিছিল তাক করে পাথর ছোঁড়া শুরু হয়, পাল্টা পাথর ছোঁড়া হয় মিছিল থেকেও৷ এর পরই হাঙ্গামা শুরু হয়ে যায়৷ যদিও সঞ্জীব কুমার নামে স্থানীয় এক বিজেপি নেতা নিজেই বলছেন, মোটরবাইক মিছিল যখন শেষের দিকে, প্রায় সবক'টা বাইক এগিয়ে গেছে, কিছু অতি উৎসাহী কিছু লোক মুসলিমদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল৷ তখনই কিছু স্থানীয় মুসলিম ক্ষেপে যায় এবং পাথর ছুঁড়তে শুরু করে৷ পুলিশ থামাবার চেষ্টা করলেও, প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে এই পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি চলে৷ কয়েকজন পুলিশকর্মী আহত হন৷
নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভার সদস্য, তথা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার চৌবের ছেলে অরিজিৎ শাশ্বত ভাগলপুরে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে প্ররোচনা দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত৷ তার নামে পুলিশ এফআইআর করার পর হুলিয়া জারি করেছে ভাগলপুর আদালত৷ ক্ষিপ্ত অশ্বিনী চৌবে বলেছেন, ‘‘পুলিশি রিপোর্ট ‘রদ্দি কাগজ কা টুকড়া৷' ভাগলপুরের দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ এমন রিপোর্ট লিখেছে৷''
মন্ত্রীর মুখে এমন কথা শুনে বেজায় চটেছে বিজেপির জোট শরিক জেডিইউ নেতৃত্ব৷ দলের জাতীয় সাধারণ সম্পাদক কে সি ত্যাগী সরাসরি বলেছেন, ‘‘বিহারে এনডিএ জোটের ক্ষতি করবে এই ধরনের মন্তব্য এবং আচরণ৷ বরং শাশ্বতর উচিত এখনই আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করা৷'' অশ্বিনী চৌবের নাম করেই ত্যাগীর কটাক্ষ, ‘‘উনি মন্ত্রিসভার সদস্য, নিশ্চয়ই আইন জানেন৷ ওঁর জানা উচিত, এই পরিস্থিতিতে কী করতে হয়৷''
বিহারের সমস্তিপুর জেলার ঔরঙ্গাবাদ শহরে একটি মসজিদে পাথর ছোঁড়ার ঘটনা নিয়েও বিজেপিকে এদিন সরাসরি সতর্ক করেছেন ত্যাগী৷ কিন্তু সব কিছু জেনেও নির্বিকার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী চৌবে৷ তিনি পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন প্রশাসনের প্রতি৷ বলেছেন, ‘‘ক্ষমতা থাকলে প্রশাসন আমার ছেলেকে গ্রেপ্তার করুক৷ সে তো আত্মগোপন করে নেই৷ কোনও অবস্থাতেই তাঁর ছেলে আত্মসমর্পণ করবে না৷'' একই অবস্থান নিয়েছেন অপর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংও৷
সম্প্রতি টুইটারে মাইক্রোব্লগিং সাইটের একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন তেজস্বী যাদব৷ সেখানে ‘ডিএসপি মুর্দাবাদ' স্লোগান দিচ্ছে জনতা৷ বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং জনতাকে এই স্লোগান দিতে উৎসাহিত করছেন৷ কিন্তু ভাগলপুরের হাঙ্গামার পর শাশ্বত চৌবে কোথায়? শোনা যাচ্ছে, তিনি গোপন আশ্রয়ে থেকে আগাম জামিনের আবেদন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷
এদিকে, বিহারের অবস্থা শোচনীয় হলেও বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে বেশি চিন্তা মোদী সরকারের৷ রানীগঞ্জ ও আসানসোলের পরিস্থিতি নিয়ে গতকালই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে রিপোর্ট তলব করেছে মোদী সরকার৷ সব মহলেই এর নিন্দা শুরু হয়েছে৷ সরব হয়েছেন উত্তরপ্রদেশের বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী৷ তাঁর অভিযোগ, ‘‘রামনবমী পালনে মিছিল ঘিরে যারা হিংসা ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়ায় পরিবর্তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে টার্গেট করা হচ্ছে৷ অথচ বিহারে একই ধরনের ঘটনায় সরকার এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে৷''