বিয়ের নামে ঋণের বোঝা মাথায় নেওয়া কি খুব জরুরি
২৭ অক্টোবর ২০২৩কিন্তু এখন বিয়ে মানে রীতিমত সিনেমার শ্যুটিং চলে! লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন…
এনগেজমেন্ট, প্রিওয়েডিং ফটোশ্যুট, ব্রাইডাল শাওয়ার, আকদ, হলদি নাইট, মেহেন্দি নাইট, সাংগীত, বিয়ে, বৌভাত.. টানা কয়েকদিন ধরে এত এত অনুষ্ঠান আর তার জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ৷
কোনো একটি অনুষ্ঠান বাদ গেলে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের কাছে মান থাকে না৷ কখনো কখনো বর-কনে মুখভার করে আফসোস করে৷ বাড়ির ছোটরা রাগ করতে থাকে তাদের আনন্দে কমতি হলো বলে৷ না, আমি কোনো উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়ের বিয়ের কথা বলছি না৷ মধ্যবিত্ত আমার উঁচুদরের উচ্চবিত্ত পরিবারের বিয়ে খাওয়া ‘সৌভাগ্য' হয়নি৷ তাই তাদের আয়োজনে আরো কী কী সব এলাহি কারবার থাকে তা আমি বলতে পারছি না৷
আমি বাঙালি শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারে কথা বলছি৷ যারা আমার চারপাশেই থাকে৷ তাদের কারো কারো বিয়েতে কখনো আত্মীয় হয়ে, কখনো বন্ধু হয়ে এবং কালেভাদ্রে প্রতিবেশী হয়ে আমি নিমন্ত্রিত হই৷ ওইসব বিয়ের জৌলুস দেখলেও বেশিরভাগ সময়ই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়৷ ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়৷ তবে বেশিরভাগ বিয়েতে অন্তত পাঁচ থেকে ছয় রকম অনুষ্ঠানতো থাকেই৷
বাঙালি শহুরে মধ্যবিত্তের জন্য বিয়ের জমকালো আয়োজন যেন আজকাল মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছে৷ বিয়েতে কে কত অর্থ ব্যয় করতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলে৷ যত জমকালো অনুষ্ঠান, তত মর্যাদা বেশি৷ আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী জমকালো সে সব বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা অনেক দিন মনে রাখবে আর তাদের মুখোমুখি হলেই শুনতে পাওয়া যাবে প্রশংসা৷
মর্যাদার এই লড়াই করতে গিয়ে এক বিয়েতেই শুধু অনুষ্ঠান আয়োজন বাবদ ২০-২৫ লাখ টাকা নেমে যায়, কারো কারো ৩০-৩৫ লাখ খরচের কথাও শুনেছি৷ চোখ তো আমার কপালে উঠবেই৷
সম্প্রতি একটি বিয়ে বাংলাদেশে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল৷ সেটা হলো টেন মিনিট স্কুলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আয়মান সাদিক এবং ওই স্কুলেরই ইংরেজির শিক্ষক মুনজেরিন শহীদের বিয়ে৷ এ জুটি এবং তাদের পরিবার অবশ্য মধ্যবিত্তের মধ্যে পড়ে কিনা তা নিয়ে আপনারা প্রশ্ন করতেই পারেন৷ আমার নিজের মনেও সেই প্রশ্ন আছে৷
তারকা জুটি আয়মান-মুনজেরিন কাজী ডেকে বিয়ে করেছেন ঢাকার একটি মসজিদে৷ কনের সাজে বাহুল্য নেই, বরও বেশ সাধারণ পোশাকে৷ তাদের এমন বিয়ের ছবি সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে যায়৷ অনেক তরুণ-তরুণী এমন সাধারণ বিয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন৷ কিন্তু গোল বাঁধে পরদিন৷ যখন তাদের জাঁকজমকপূর্ণ গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ও ডিজে পার্টির ভিডিও রীতিমত ভাইরাল হয়৷ শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক৷
তাদের বিয়ে বা বৌভাতের আয়োজনও ছিল দারুণ জমকালো৷ আয়মান নাকি বিয়ের গেটেই ১০ লাখ টাকা দিয়েছেন! অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের ছেলে আয়মান সাদিক৷ টেন মিনিট স্কুল দিয়ে নিজেও বেশ অর্থকড়ির মালিক হয়েছেন৷ মুনজেরিনের পরিবারও উচ্চমধ্যবিত্ত৷ তাই তারা বিয়েতে টাকা খরচ করতেই পারেন! আমার তাতে এতো হিংসে হচ্ছে কেনো?
ঠিক ধরেছেন, হিংসে যে একটু হচ্ছে সেটা কিন্তু সত্যি৷ আর এ কারণেই আমি তাদের বিয়ের প্রসঙ্গ টেনেছি৷ লাখো বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীর চোখে আয়মান-মুনজেরিন আদর্শ জুটি৷ তাই তারাও তাদের মত করে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখবে৷ গোলমালটা এখানে৷ আমার বাবা উচ্চবিত্ত নন, আর আমিও আয়মান বা মুনজেরিনের মত রোজগার করি না৷ কিন্তু স্বপ্ন দেখি তাদের মত বিয়ের আয়োজনের৷ যার পুরোটা চাপ গিয়ে পড়ে পরিবার এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজের উপর৷
সন্তানের বিয়েতে বাবা-মা কে তাদের শেষ সঞ্চয় পর্যন্ত ব্যয় করতে দেখেছি, বিশেষ করে মেয়ের বিয়েতে৷ এদিকে, বরের পরিবারকে অতটা চাপ না নিতে হলেও অনেক ছেলেকে দেখেছি বিয়ের খরচের জন্য বড় অংকের ঋণ করতে৷ গায়ে হলুদ বা হালদি নাইটে রাতভর উচ্চ শব্দে ডিজে পার্টি না করতে পারলে মান যাবে যে৷ মেহেদি পরতে পার্লার থেকে লোক আনা চাই, সব অনুষ্ঠানের জন্য সাজতে পার্লারে যেতেই হবে৷ ফটোগ্রাফার দিয়ে নানান ধাপে ছবি তুলতে হবে৷ ‘বিয়েতে ফটোগ্রাফার না থাকলে বিয়ে করে কী লাভ, পরে তো শুধু এই ছবিগুলোই থাকবে'..অনেক কনের মুখে আমি এ কথা শুনেছি৷ যেন বর না থাকলেও চলবে কিন্তু ফটোগ্রাফার থাকা চাই ই চাই৷
এই ফটোগ্রাফারদের যন্ত্রণায় বিয়ে বাড়িতে আজকাল বর-কনের দেখা মেলাই ভার৷ ফটোগ্রাফাররাই থাকে বিয়ে নামক সিনেমার শ্যুটিংয়ে পরিচালকের ভূমিকায়৷ তারা বর-কনেকে তুলে নিয়ে শহরময় ছবি তুলে বেড়ায়, বিয়ের স্টেজেও থাকে তাদেরই রাজত্ব৷ তাদের অনুমতি ছাড়া বর-কনের কাছে ঘেঁষার কোনো উপায় নেই৷ কেন রে ভাই?
বিয়ে মানে আসলে কী? বিয়ে মানে তো দুজন মানুষের বন্ধন, দুটো পরিবারের আত্মীয়তা৷ বিয়ে সমাজের ধারক, বাহক৷ খুব বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই৷ এই আশি-নব্বইয়ের দশকে মধ্যবিত্তের বিয়ে মানে ছিল বাড়ির ছাদে কিংবা উঠানে প্যান্ডেল টানিয়ে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন৷ আত্মীয়-প্রতিবেশীদের মধ্যে যে ভালো সাজাতে পারতো, তার ডাক পড়তো কনে সাজাতে৷ তখন বউ মানে লাল টুকটুকে বেনারশী শাড়ি, মুখে স্নো-পাউডার, ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে কাজল, খোঁপায় ফুল, গায়ে সাধ্য অনুযায়ী গহনা আর মিষ্টি লাজুক হাসি৷ কারো কারো পারিবারিক আবহে গায়ে হলুদের ছোট্ট আয়োজনও হতো৷
যারা নিমন্ত্রিত তারাও নতুন শাড়ি কিনতে এখনকার মত বাজারে ছুটতেন না৷ বরং আলমারি খুলে সবচেয়ে ভালো শাড়িটা আর নিজের থাকা গয়না থেকে কিছু একটা পরে যেতেন অনুষ্ঠানে৷ তারপর আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়, নতুন আত্মীয়দের সঙ্গে পরিচয় আর বর-কনেকে দোয়া বা আশীর্বাদ করা৷ সঙ্গে খাওয়া- দাওয়া৷ ছবি তুলতে খোঁজ পড়তো যার কাছে ক্যামেরা আছে তার৷ প্রয়োজন মত ‘ফ্লিম' কিনে দিলে ক্যামেরার মালিক দায়িত্ব নিয়ে বিয়ের আয়োজনের ছবি তুলে দিত৷
সেই সময়ের আয়োজনের তুলনায় এই সময়ের আয়োজনে কোনো এত তফাৎ৷ কেনো আজকাল বিয়ের আয়োজনে এত জাঁকজমক৷ বিয়ের সব আয়োজনের জন্য আলাদা করে হল ঘর ভাড়া না করলেই নয় (ভাগ্যিস বলিউডের মত ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ের ভূত এখনো মধ্যবিত্তের ঘাড়ে সেভাবে চেপে বসতে পারেনি), সেইসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, অনুষ্ঠান অনুযায়ী পোশাক-গহনা, ডিজে পার্টি, পার্লার; তবে কী ওই সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা এগিয়ে গেছে৷ সরকার অবশ্য তাই দাবি করে৷ বলে, বাংলাদেশ এখন মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চমধ্যবিত্ত দেশে পরিণত হয়েছে৷ কোনো কোনো মন্ত্রী তো আরো কয়েক কাঠি এগিয়ে দেশকে সিঙ্গাপুর-সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করেন৷
অথচ, আমি দেখতে পাই মধ্যবিত্তের দৈনিক খাবারের তালিকা থেকে মাংস-মাছের পর এবার ডিম বরাদ্দও কমে গেছে৷ বাজার করতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খাওয়া মানুষগুলো যখন তা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলে, তখন সত্যিই বুকের কোথায় যেনো ব্যথায় চিনচিন করে ওঠে৷ বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে জ্যামিতিক হারে আর চাকরিজীবীর আয় বাড়ে গাণিতিক হারে৷ তাই মধ্যবিত্ত পরিবারে এখন আর সঞ্চয় বলে কিছু থাকে না৷
আগে সন্তান জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে খরচ কমিয়ে তাদের লেখাপড়া ও বিয়ে বাবদ একটু একটু করে সঞ্চয় শুরু করতো বাবা-মা৷ এটা আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে একরকম প্রথায় পরিণত হয়েছিল৷ মেয়ের জন্য একটু একটু করে গয়না গড়া হত৷ যাতে বিয়ের সময় চাপ না পড়ে৷
এখন এসব কিছু সম্ভবই না৷ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি৷ আমার সরকারি চাকুরে বাবার একার রোজগারে পুরো নয় সদস্যের পরিবার চলতো৷ সঙ্গে বাড়িতে বাবা-মাকে খরচ পাঠানো৷ ভাইবোনদের বিপদে-আপদে, আনন্দ-অনুষ্ঠানে এগিয়ে যাওয়া৷ সবই চলতো তার একার রোজগারে৷ রোজার ঈদ আর জন্মদিন ছাড়াও যে নতুন জামা কেনা যায় সেটা জানা ছিল না৷ বছরে এক জোড়া জুতাই বরাদ্দ ছিল৷ তখন বিত্তবৈভব দেখি মিথ্যা সামজিক মর্যাদা আদায়ের চল ছোট্ট মফস্বল শহরে তেমন একটা ছিল না৷ ব্যয় কমিয়ে আমাদের চার বোনের জন্য বাবা কিছু সঞ্চয় করে রেখে গেছেন বিধায় তার অকালমৃত্যুর পরও আমার পরিবারকে ভেসে যেতে হয়নি৷
অথচ, আমি আর আমার স্বামী দুজনই চাকরি করি৷ রোজগার নেহাৎ মন্দ নয়৷ চাল-চলনে সচ্ছল মধ্যবিত্ত৷ অথচ, সঞ্চয়ের খাতা শূন্য৷ নিত্যপণ্যসহ সব কিছুর আকাশ ছোঁয়া দামে যা আয় তার পুরোটাই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে৷
আমাদের সমাজ এবং আমাদের দেশেরও আমার মত অবস্থা৷ আয় বাড়ছে বটে, কিন্তু তার থেকে ব্যয় বাড়ার গতি অনেক বেশি৷ তাই মাসে অধিক ব্যয় করা দেখে এটা ভাববেন না আমাদের সামর্থ্য বেড়েছে৷ বরং ভেতরটা দিন দিন ফাঁপা হয়ে যাচ্ছে৷
বিয়ে পারিবারিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে অত্যন্ত জরুরি একটি কাজ৷ বিয়ের একটি পবিত্র বন্ধন এবং এর নিজস্ব মর্যাদা রয়েছে৷ প্রকৃত মর্যাদাকে পাশ কাটিয়ে বিয়ে নিয়ে ঠুনকো মর্যাদার যে প্রতিযোগিতায় বাঙালি মধ্যবিত্ত নেমেছে তাতে নিজের মাথার উপর বিপদ ডেকে আনা ছাড়ার আর কোনো কাজই হয় না৷ জাঁকজমকে ভরা বিয়ের আয়োজন করে পরিবার অথবা নিজের মাথার উপর বিশাল ঋণের বোঝা নিয়ে আনন্দের সঙ্গে নতুন জীবন কী শুরু করা সম্ভব? আমার তো মনে হয় না৷
ধার্মীয়ভাবেও বিয়ে নিয়ে অতিসজ্জার করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে৷ গবেষণাতেও দেখা গেছে, কম খরচের বিয়েই দীর্ঘস্থায়ী হয়৷ এমরি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা বিয়ের খরচের সঙ্গে বিয়ে স্থায়িত্বের সময়কালের মধ্যে যোগসূত্র পর্যবেক্ষণ করেছেন৷ তারা দেখতে পান, জাঁকজমকভাবে বিয়ে সারতে অনেকেই সাধ্যের অতীত খরচ করেন৷ যেজন্য ঋণ করতে হয়৷ যা শোধ করতে গিয়ে পরবর্তী সময়ে সংসারে চাপ বাড়ে৷ ওই ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অনেকেই বিপাকে পড়েন৷ কারণ নতুন সংসারেও যে অনেক খরচ৷ ফলে বিয়ের পর থেকেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া ও মনোমালিন্য দেখা দেয়৷
তাই ফেসবুকে বছর জুড়ে নিজের বিয়ের ছবি-ভিডিও পোস্ট করে অন্যকে বিরক্ত করা আর গালভরা গল্প বলে অন্যের চোখে হিংসের ঝলক দেখার চাইতে স্বল্প খরচে বিয়ে করাই উত্তম৷ না হলে আয়মান-মুনজেরিনের প্রথম দিনের মসজিদে গিয়ে সাদাসিধে বিয়ে কী আর এত প্রশংসা কুড়াতো৷ পরের দিনগুলোর জাঁকজমক তো প্রশংসার চেয়ে সমালোচনা কুড়িয়েছে বেশি৷