1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গণধর্ষিতা যুবতী

শীর্ষ বন্দোপাধ্যায়, কলকাতা২৫ জানুয়ারি ২০১৪

২০ বছরের মেয়েটি সমাজের প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে গিয়ে ভিন্ন সম্প্রদায়ের এক যুবককে ভালোবেসেছিল৷ কিন্তু এর পরিণতি ভয়াবহ৷ গ্রামের মোড়লের নির্দেশে গণধর্ষিতা হয় সে!

https://p.dw.com/p/1AwlK
Indien fünfjähriges Mädchen Vergewaltigung zweiter Verdächtiger 21.04.2013
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images

না, পাকিস্তানের মুজফফরগড় নয়, যেখানে গ্রামসভার নির্দেশে গণধর্ষণ করা হয়েছিল মুখতারণ মাঈ-কে৷ হরিয়ানা, পঞ্জাব বা উত্তর ভারতের কোনো প্রত্যন্ত গ্রামের ঘটনাও নয়, যেখানে প্রায়শই খাপ পঞ্চায়েতের নির্দেশে খুন করা হয় ‘বেয়াড়া' ছেলে-মেয়েদের৷ এবারের ন্যায়বিচারের মঞ্চ হল শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক এবং সচেতন রাজ্য হিসেবে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গ৷ সেই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর থানা এলাকা৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী যে জেলায়, সেই বীরভূম৷ সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাস ছিল যেখানে, সেই লাভপুরের রাজারামপুর গ্রাম৷ সেখানেই উপজাতীয় গোষ্ঠীর এক প্রাপ্তবয়স্কা মেয়ে ভালোবেসেছিল অন্য সম্প্রদায়ের একটি ছেলেকে৷ সেই ‘অপরাধে' প্রথমে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল তাদের৷ কিন্তু জরিমানা আদায় করতে না পেরে গ্রামের পুরুষরা সারা রাত ধরে পালা করে ধর্ষণ করে মেয়েটিকে!

ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার৷ লোক জানাজানি হয়েছে পরের দিন, বুধবার, মেয়েটি পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করার পর৷ বৃহস্পতিবার খবরের কাগজে যে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর স্তম্ভিত গোটা রাজ্য, দেশ! মেয়েটির অভিযোগের ভিত্তিতে ধর্ষণের দায়ে ১৩ জন বিভিন্ন বয়সের পুরুষ গ্রেপ্তার হয় বুধবার রাতেই৷ কিন্তু বৃহস্পতিবার তাদের সিউড়ি আদালতে তোলা হলে, পুলিশ তাদের হেফাজতে নেওয়ার আবেদন না করায় ১৩ জনকে ১৪ দিনের জেল হেফাজতে পাঠিয়ে দেন বিচারক৷ জেলা পুলিশের এই উদ্যোগহীনতা এবং নির্বিকার মনোভাবে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাতারাতি পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন বীরভূম জেলার পুলিশ সুপারকে৷ তিরস্কৃত হয়েছেন রাজ্য পুলিশের অন্যান্য পদাধিকারীরাও৷ কিন্তু ক্রমশ এই ঘটনা সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে, তা গ্রামসমাজের নির্মম মানসিকতা সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে৷

যেমন জানা যাচ্ছে, লাভপুরের এক তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য আগাগোড়া উপস্থিত ছিলেন রাজারামপুরের পাশের গ্রাম সুবলপুরে মঙ্গলবার বসা ওই সালিশি সভায়, যেখানে ওই দুই বিবাহ-ইচ্ছুক যুবক-যুবতীর ‘বিচার' করে, তাদের মাথাপিছু ২৭ হাজার টাকা করে জরিমানা ধার্য করেছিল গ্রামের মোড়ল৷ নিম্নবিত্ত পরিবারের ওই ছেলে-মেয়েদের অত টাকা দেওয়ার সামর্থ না থাকায় মোড়লের নিদান ছিল, তা হলে গ্রামের পুরুষরা ওই মেয়েটিকে নিয়ে ‘ফূর্তি' করে নিক! সেই অমানবিক ফূর্তিই চলেছিল মঙ্গলবার সারা রাত ধরে এবং মেয়েটির বয়ান অনুযায়ী, সদ্য বয়োঃপ্রাপ্ত কিশোর থেকে শুরু করে তার বাবার বয়সি লোকেরাও সেই আমোদে সামিল হয়েছিল! বহু কাকুতি-মিনতি, শারীরিক যন্ত্রণার তীব্র আর্তনাদ সত্ত্বেও মেয়েটিকে পালা করে ধর্ষণ করে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেদিন৷

Indien Vergewaltigung
ছবি: STRDEL/AFP/Getty Images

তবে সবথেকে উদ্বেগজনক প্রবণতা ধরা পড়েছে মেয়েটির গ্রামের মহিলাদের কথায়, যারা রীতিমত ক্ষিপ্ত যে, মেয়েটি কেন পুলিশের কাছে গিয়ে নালিশ করল! অর্থাৎ বিচারের নামে যে নির্যাতন হয়েছে মেয়েটির উপর, তাতে পরোক্ষে তাদের সায়ই আছে! এবং সেখানেই শেষ নয়, পুলিশ এবং সংবাদমাধ্যমের সামনে বারবার মেয়েটির চরিত্রহীনতার কথা বলে, মেয়েটির বাড়িতে ছেলেটির সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়ার গল্প বানিয়ে ওই মহিলারা প্রমাণ করতে মরীয়া যে, দোষ মেয়েটিরই! এবং তাকে যদি শাস্তি না দেওয়া হতো, তা হলে সমাজের কাছে ভুল সংকেত যেত৷ ‘‘আমাদের বাড়ির মেয়েরাও খারাপ হয়ে যেত'', সমবেতকণ্ঠে বলেছেন ওই মহিলারা৷ যদিও পুলিশের কাছে দেওয়া বয়ানে মেয়েটি যা জানিয়েছে, তাতে বোঝা যায় যে, ভদ্র সমাজের প্রথা মেনেই বিয়ের কথা বলতে ছেলেটি তাদের বাড়ি এসেছিল৷ তখনই দলবল নিয়ে চড়াও হয় গ্রামের মোড়ল বলাই মাড্ডি৷ তাদের দু'জনকে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় মোড়লের বাড়িতে, বিচারসভা বসে সেখানেই৷ এবং শেষ পর্যন্ত ওই বাড়ির রান্নাঘরেই মেয়েটি গণধর্ষিতা হয় রাতভর৷

গুরুতর আঘাত নিয়ে মেয়েটি এখন সিউড়ি জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন৷ গ্রেপ্তার হয়ে জেলহাজতে ওই মোড়লসহ ১৩ জন অভিযুক্ত৷ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসনও৷ হয়ত দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে শাস্তিবিধানও হয়ে যাবে দোষীদের৷ হয়ত মেয়েটিও একদিন আবার সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে৷ এই ভয়ঙ্কর গণধর্ষণের ক্ষত একদিন হয়ত শুকিয়ে যাবে তার হৃদয় থেকে৷ কিন্তু যে সমাজ এখনও ধর্ষণকে ফূর্তি ভাবে, ন্যায়বিচার ভাবে, সেই সমাজ যে কোন ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তা ভাবতেও ভয় হয়!