‘‘বুধবারের মধ্যে হামলা সম্ভব’’
৩০ আগস্ট ২০১৩ব্রিটেনের সরে যাওয়ার পর সিরিয়ায় সামরিক অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র কাউকে পাশে পাবে কিনা – এ নিয়ে যখন গণমাধ্যমে ব্যাপক ঝড় চলছে, তখন জানা গেল ফ্রান্সের অবস্থান৷ ফরাসি প্রেসিডেন্ট জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথেই আছেন তারা৷ শুক্রবার স্থানীয় পত্রিকা ‘লে মঁন্দ'-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ওলঁদ বলেন, সিরিয়ার জনগণকে রক্ষায় তারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা সঠিক৷ শুধু তাই নয়, ব্রিটেনের অবস্থান পরিবর্তন তাদের সিদ্ধান্তে কোনো প্রভাব ফেলবে না৷ বুধবার সিরিয়া ইস্যুতে আলোচনা করতে জরুরি বৈঠকে বসবে ফ্রান্সের পার্লামেন্ট৷
বৃহস্পতিবার সিরিয়ার আসাদ সরকারের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য হামলার প্রস্তাব নাকচ করে দেন ব্রিটেনের সংসদ সদস্যরা৷ সেদিন রাতে যুক্তরাজ্যের সংসদে এ হামলা নিয়ে নীতিগত সমর্থন দেননি তারা৷ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে হামলার পক্ষে ভোট পড়েছে ২৭২টি আর বিপক্ষে ২৮৫টি৷ গ্রীষ্মকালীন ছুটির মধ্যে ডাকা এ অধিবেশনে সিরিয়া হামলার বিষয়ে নীতিগত সমর্থন লাভ ও আইন পাশই ছিল মূল উদ্দেশ্য৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সিরিয়া হামলায় যুক্তরাজ্যের সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, সরকার আইন অনুযায়ী কাজ করবে৷
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনকে ঘনিষ্ট মিত্র ও বন্ধুরাষ্ট্র অভিহিত করে বলেছে তারা এখনও মিত্র দেশগুলোর সাথে আলোচনা চালিয়ে যাবে৷ গতকাল হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে উত্তম দিকটি বিবেচনা করেই প্রেসিডেন্ট ওবামা সিদ্ধান্ত নেবেন৷ প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র দেশের স্বার্থে একাই লড়বে বলে বিবৃতিতে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে৷
উল্লেখ্য, জার্মানি সিরিয়ার বিরুদ্ধে হামলায় অংশ নিচ্ছে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডো ভেস্টারভেলে৷
মিত্র খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র
ব্রিটেন সরে যাওয়ার পরও সিরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অন্য দেশগুলোর সমর্থন খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র – শুক্রবার এমনটাই জানালেন, মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী চাক হেগেল৷ তবে এক্ষেত্রে কারা কারা এই জোটে থাকবে সে বিষয়ে কিছু জানাননি তিনি৷ ব্রিটেনের সরে যাওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা রয়েছে এবং প্রত্যেক দেশেরই উচিত তাদের দায়িত্ববোধ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া৷
ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হামলার কারণে সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশ ইসরায়েল রাজধানী তেল আভিভে এরই মধ্যে ‘আয়র ডোম' ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করেছে৷ শুক্রবার সকালে এতে ব্যাটারি সংযোগ করা হয়েছে বলে স্থানীয় সামরিক রেডিওতে বলা হয়েছে৷ ঐ অঞ্চলে সাম্প্রতিক উত্তেজনার জন্য নিজ দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে তারা মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করতে যাচ্ছে বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু৷
টেলিভিশনে দেয়া বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, সিরিয়া যুদ্ধের সাথে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই৷ কিন্তু ইসরায়েলের জনগণের কেউ ক্ষতি করার চেষ্টা করলে দেশের সেনাবাহিনী তার জবাব দিতে বাধ্য হবে৷ ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে বলে সেনা সূত্র নিশ্চিত করেছে৷
রাসায়নিক অস্ত্র ভাণ্ডার হামলার ক্ষেত্রে হুমকি
সিরিয়ায় হামলার ক্ষেত্রে রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদের বিষয়টি বিশেষজ্ঞদের ভাবনায় ফেলেছে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র নিরাপদ স্থান ভেবে যদি অস্ত্র ভাণ্ডারে আঘাত হানে তাতে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে৷ ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস' বা এপি এ বিষয়ে পাঁচজন বিশেষজ্ঞের সংঙ্গে কথা বলেছে এবং তাদের সবার এ বিষয়ে একই মত৷
অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ডেরিল কিম্বল বলেন, মার্কিন সেনাবাহিনী জানে না, ঠিক কোথায় কোথায় সিরিয়ার সেনাবাহিনীর অস্ত্র মজুদ আছে, ফলে হামলায় কিছু অস্ত্র যেমন ধ্বংস হতে পারে, তেমনি রাসায়নিক অস্ত্র থাকলে তা গ্যাস আকারে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে এবং সাধারণ মানুষ সহজেই আক্রান্ত হবে৷ তিনি বলেন, রোগ হওয়ার পর চিকিৎসা করার চেয়ে এর প্রতিরোধ করাটাই উত্তম৷ তাঁর কথায়, ধারণা করা হচ্ছে, দামেস্ক, হোমস এবং হামার মতো বড় শহরগুলোর আশেপাশে বেশ কিছু অস্ত্রের মজুদ রয়েছে৷ এই শহরগুলোতে ২০ লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস৷
প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, ঐ স্থানে না গিয়ে রাসায়নিক অস্ত্রের যে প্রভাবক সেটিকে পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব কিনা৷ এ প্রশ্নের জবাবে ফরাসি বিশেষজ্ঞ রাল্ফ ত্রাপ জানান, রাসায়নিক অস্ত্র উদ্ধার করে তা ধ্বংস করা খুব একটা সহজ নয়৷ বিশেষ করে দিনেরবেলা বাতাস এবং তাপমাত্রার প্রভাব, ভবনের গঠন, রাসায়নিক অস্ত্রটির ধরণ – এসব কিছুর উপর ভিত্তি করছে এর ভয়াবহতা৷ পেন্টাগনও এ বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত৷ দুঘর্টনার ফলে যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটে যায়, তার ফলাফল হবে ভয়াবহ৷
গত ছয় মাস ধরে সিরিয়ার অস্ত্রের মজুদের স্থান নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা৷ কেননা বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনী এবং বিদ্রোহীদের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে গোয়েন্দারা তাঁদের সঠিক অবস্থান নির্ণয়ে হিমশিম খেয়েছে৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চারজন মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা একথা জানিয়ে বলেছেন, সিরিয়ায় হামলার এটাও অন্যতম কারণ৷ এছাড়া, আরো একটি বিষয়ের আশংকা রয়েছে৷ আর তা হলো, হামলার পর এসব রাসায়নিক অস্ত্র ইসলামি জঙ্গি ও আসাদ সমর্থকদের হাতে পড়লে তার বিরূপ ফল হতে পারে৷
কি করছে জাতিসংঘ পরিদর্শক দল?
দামেস্কের উপকণ্ঠে ২১শে আগস্ট যে রাসায়নিক হামলা চালানো হয়েছে, সোমবার থেকে তার নমুনা সংগ্রহ করা শুরু করেছে জাতিসংঘের একটি পরিদর্শক দল৷ ঘটনাস্থলের মাটি, তাতে লেগে থাকা রক্ত এবং কাপড়-চোপড় থেকে নমুনা সংগ্রহ করে চলছে পরীক্ষা৷ তবে মৃতদেহ থেকে রক্তের নমুনা না নেয়ায় অবাক হয়েছেন চিকিৎসক আবু আক্রাম, যিনি বিশেষজ্ঞ দলটিকে সাহায্য করছিলেন৷ কেবল একটি নমুনায় রাসায়নিক গ্যাসের উপস্থিতি পেলে হবে না, সবগুলোর রিপোর্ট এক হলে তবেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন বিশেষজ্ঞ রাল্ফ ত্রাপ৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তিন বিশেষজ্ঞসহ জাতিসংঘের ঐ পরিদর্শক দলটি শনিবার সিরিয়া ছাড়বে৷ একমাত্র তার পরেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সেইসব রিপোর্ট অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন৷
চলতি মাসের ২১শে আগস্ট সিরিয়ার দামেস্কের কাছে বিদ্রোহীদের ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকায় রাসায়নিক হামলা চালায় আসাদ-বাহিনী৷ এরই জের ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদেশগুলো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে৷
এপিবি / ডিজি (এএফপি, এপি, রয়টার্স)