ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক
২১ আগস্ট ২০১৪কিছু দিন আগে পর্যন্ত মনে হয়েছিল নতুন দিল্লি ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক ইতিবাচক মোড় নিতে পারে৷ গত ২৬শে মে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের উপস্থিতি সেই বার্তাই দিয়েছিল৷ তারই জের টেনে স্থির হয়েছিল যে, আগামী ২৫শে আগস্ট ইসলামাবাদে বসবে দু'দেশের পররাষ্ট্র সচিব স্তরে বৈঠক৷ অর্থাৎ উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে উভয় দেশ একে অপরের প্রতি কূটনৈতিক দোষারোপ ও পাল্টা দোষারোপের চিরাচরিত অভ্যাস থেকে বিরত ছিল৷ বাক-যুদ্ধের উত্তাপ ছিল স্তিমিত৷ এর প্রেক্ষিতে মনে হয়েছিল, ভারত ও পাকিস্তান তাদের তথাকথিত সার্বিক সংলাপ আবার শুরু করার পথ খুঁজে পাবে, যার দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ২০০৮ সালে মুম্বই সন্ত্রাসী হামলার পর৷ প্রসঙ্গত, এই হামলা চালিয়েছিল লাহোর-ভিত্তিক ইসলামিক লস্কর-ই-তৈয়বা জঙ্গি গোষ্ঠী, এই অভিযোগ তুলে পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত৷
কিন্তু আগামী ২৫শে আগস্ট ইসলামাবাদে পররাষ্ট্র সচিবস্তরের বৈঠক নতুন দিল্লি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় সেই আশা ধুলিসাৎ হয়ে গেল৷ আপাত দৃষ্টিতে এই সিদ্ধান্ত ন্যায়সঙ্গত মনে হতে পারে৷ দিল্লির আপত্তি অগ্রাহ্য করে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে দিল্লির পাকিস্তানি হাইকমিশনার আব্দুল বাসিদের বৈঠক করাকে ভারত মনে করে নতুন প্রধানমন্ত্রী মোদীর গঠনমূলক কূটনৈতিক প্রয়াসে পাকিস্তানের আন্তরিকতাকে প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে৷ তবে এটাও ঠিক যে, এর আগে বহুবার ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, কিন্তু এরকম তীব্র প্রতিক্রিয়া এর আগে কখনো হয়নি৷ মনে হয় এবারে মোদীর প্রতিক্রিয়া মাত্রাতিরিক্ত৷
ভারতের এই কড়া অবস্থানের কারণ কী?
ভারতের মতে, গত ১০ দিনে কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং আন্তর্জাতিক সীমান্তে ঘন ঘন গুলি বিনিময় এবং ১১ বার সংঘর্ষ বিরতি লঙ্ঘন করেছে পাকিস্তান৷ ফলে মোদী পড়েছে সংকটে৷ কট্টরপন্থি হিন্দুত্ববাদী নেতা মোদী হালের নির্বাচনি ময়দানে ভারতকে সামরিক দিক থেকে মজবুত করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেটা না রাখতে পারলে সেটাকে মোদীর দুর্বলতা বলেই মনে করবে সবাই৷ সেই ১৯৪৭ সাল থেকে কাশ্মীর দু'দেশের ভূখণ্ড বিবাদের কেন্দ্রভূমি৷ পরমাণু শক্তিধর দুটি দেশের মধ্যে গত ৬৭ বছরে তিন তিনবার যুদ্ধ হয়৷ মুম্বই সন্ত্রাসী হামলার পর আরেকবার যুদ্ধের মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল৷ ভারত নিঃসন্দেহ যে, ইসলামিক সন্ত্রাসীরা কাশ্মীরে আবার গন্ডগোল সৃষ্টি করতে চাইছে পাকিস্তানে তাদের প্রভুদের সবুজ সংকেত পেয়ে৷ এই ধারণাটা মোদী স্পষ্ট করে দিয়েছেন গত সপ্তাহে কাশ্মীর সফরকালে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ছায়াযুদ্ধ চালাবার অভিযোগ তুলে৷
বৈঠক বাতিল করার ফলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এখন ‘ব্যাক-ফুটে'৷ মোদীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে এসে নওয়াজ শরিফ পাকিস্তানের সামরিক কর্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এ ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করার সাহস দেখিয়ে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের মর্যাদা বাড়িয়েছিলেন৷ বলা বাহুল, পাকিস্তানের বিদেশ ও প্রতিরক্ষা নীতিতে এই দুই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনস্বীকার্য৷ এদের লক্ষ্য ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা জিইয়ে রাখা৷ অথচ, বড় কোনো আশঙ্কা ছাড়া প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল ব্যয় পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিক মেনে নিতে পারছে না৷
নওয়াজ শরিফ চান ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত করে বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নতি৷ তাতে উভয় দেশই হবে উপকৃত৷ পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা হবে ভালো৷ কাজেই কাশ্মীরে ইসলামিক সন্ত্রাসী কার্যকলাপে প্রস্রয় দেবার ব্যক্তি শরিফ নন৷ ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের সুস্থিতি ব্যাহত করতে অতীতে জঙ্গিদের আর্থিক সাহায্য এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে এসেছে আইএসআই, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য৷ সীমান্তে জঙ্গি অনুপ্রবেশ এবং জঙ্গি তৎপরতা নতুন কোনো সমাপতন নয়৷ হিন্দু লৌহ মানুষ মোদীকে প্ররোচিত করা অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শরিফকে হেয় করা৷ শরিফ এখন নিজের দেশেই রাজনৈতিক সংকটে জেরবার৷ তাঁর ইস্তফার দাবিতে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু করেছে ইনসাফ পার্টির ইমরান খান এবং মুসলিম মৌলবি তাহিরুল কাদরি৷ দু'জনের পেছনেই আছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পৃষ্টপোষকতা৷
ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কের উন্নতি যাঁরা চায় না, মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়িয়ে তাঁদের উদ্দেশ্যই হয়ত সফল হবে৷ পাশাপাশি শরিফকে তাঁর ভারত নীতি বদলানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করে চলেছে৷ এখন উভয় নেতার পক্ষে জরুরি কিভাবে তাঁদের বিরুদ্ধ শক্তি বাগে আনা যায়৷ তবে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ মনে হচ্ছে৷