‘ফেরেশতা দিয়ে কমিশন করলেও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না’
৭ জানুয়ারি ২০২২কেন সংলাপে যাননি? এই সংলাপে আদৌ কী কোন ফল মেলে? কীভাবেই বা একটা ভালো নির্বাচন কমিশন হতে পারে? এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম৷
ডয়চে ভেলে : নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির যে সংলাপ, সেটা কতটুকু সফল হওয়া সম্ভব?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : মহামান্য রাষ্ট্রপতি এই ধরনের সংলাপ এর আগেও করেছেন৷ সেই সংলাপে আমরা যোগদান করেছিলাম৷ তিনি যে চিঠি পাঠিয়েছেন, আগেও সেই বয়ান দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন৷ যে সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিতে হবে৷ এবং সেজন্য পরামর্শ করার উদ্দেশ্যে তিনি আমাদের সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন৷ প্রথম কথা হলো, সংবিধানের একটা অংশ তিনি উল্লেখ করেছেন৷ কিন্তু সংবিধানের যে অংশটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া সব বিষয়েই রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কাজ করতে হবে৷ যাকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মত কাজ করতে হয় তিনি আবার অন্য কারও পরামর্শ নিলেও সেই পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার তো অধিকার রাখেন না৷ আমরা আগেও বলে এসেছিলাম তিনি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে পরামর্শ না করে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করতে হলে সংবিধানে আরেকটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে৷ ওখানে বলা আছে, আইনের বিধিবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিতে হবে৷ সেই আইনী বিধিবিধানটা কোথায়? ৫০ বছরে এটা হয়নি৷ মহামান্য রাষ্ট্রপতির এটাই বুদ্ধিমানের কাজ হতো যদি তিনি একটা বার্তা পার্লামেন্টের কাছে পাঠাতেন যে, সংবিধানের এই ধারাটাকে কার্যকর করার জন্য আগামী এক মাসের মধ্যে তোমরা নির্বাচন কমিশন নিয়োগের ব্যাপারে বিধিবিধান প্রণয়ণ করে আমার স্বাক্ষরের জন্য পাঠাও৷ তাহলে সেটা কার্যকরী কোন কাজ হতো৷
বর্তমান ব্যবস্থায় সরকারের চাওয়া উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপতির পক্ষে কী স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব?
সাংবিধানিকভাবেই এটা সম্ভব না৷ আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মাঝে মধ্যেই বলেন, আমার তো কোন কাজ নেই৷ সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাতে হয়৷ প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া আর কারও জানাযায় যোগ দেওয়া ছাড়া তো আমার কোন কাজ নেই৷ ফলে উনি তো না জানার মতো মানুষ না৷ আমরা তো গতবার সব কথাই বলে এসেছি৷ এগুলো আবার নতুন করে বলার তো প্রয়োজন নেই৷ গতবার আমরা যে গেলাম, পরামর্শ দিলাম তার রেজাল্টটা কী দাঁড়াল? রাষ্ট্রপতি এমন একজন মানুষকে নিয়োগ দিলেন যে, তিনি ৩০ ডিসেম্বরের ভোট ২৯ তারিখে রাতের অন্ধকারে করে ফেললেন৷ সেটা সরকারসহ স্বীকার করল এটা খুব একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি৷ আইন রক্ষার জন্য আমাদের বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে৷ তিনি যে একটা ভুল লোককে নিয়োগ দিয়েছিলেন তার জন্য আমাদের নির্বাচনের মুখে চুনকালি পড়ে গেল৷ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়ে গেল৷ সেটার জন্য তিনি নিশ্চয় দুঃখিত হয়েছেন বলে আমি আশা করব৷ জনগনের কাছে সেটা দুঃখপ্রকাশ করে বলা উচিৎ ছিল আমি ভুল লোককে পছন্দ করেছি৷ এবার আর এটা হবে না৷ সেই কথা তো তিনি বলেননি৷
আগের বার সার্চ কমিটি যে নামগুলো দিয়েছিল, তাদের বাদ দিয়ে পৃথক ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল, এটাই কি আপনি বলছেন? তাহলে এই ধরনের সংলাপের ফল কী?
এটা সেকেন্ডারি প্রশ্ন৷ সার্চ কমিটি করুক আর যে কমিটি করুক শেষ পর্যন্ত তো প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কিছু করতে পারেন না৷ নাম প্রস্তাব করার জন্য বারবার কেন এই কাজের মধ্যে যাবেন? আইনের বিধান করার জন্য তো সংবিধানে নির্দেশনা আছে৷
আইনের বিধানটা কেন হচ্ছে না?
এটা হচ্ছে না এই কারণে যে, ক্ষমতাসীনেরা চাবিকাঠিটা নিজেদের হাতে রাখতে চায়৷ বিএনপিও তাই করেছে, তাদের শাসনামলে তারা আইনটা করেনি৷ আওয়ামী লীগও করছে না, কারণ তারা ক্ষমতাসীন৷
আপনারা যারা এই সংলাপে যাননি, রাষ্ট্রপতি অন্য কোনভাবে উদ্যোগ নিলে কী যেতেন?
আমরা তো রাষ্ট্রপতিকে সব কথা বলে এসেছি৷ আমরা এবার চিঠি দিয়ে বলেছি যে, আমরা আগেই আপনাকে সব কথা বলে এসেছি৷ আমাদের নতুন করে কিছু বলার নেই৷ আমরা আগেই ৫৩টি সুপারিশ দিয়েছি৷ নির্বাচন ব্যবস্থা আমূল ঢেলে সাজাতে হবে৷ এই সিস্টেম চলবে না৷ রাজনৈতিক দলগুলো যত শতাংশ ভোট পাবে, তত শতাংশ আসন পাবে৷ এর ব্যাখা আমরা করেছি৷ নির্বাচনকে পেশিশক্তি, টাকা, প্রশাসনিক কারসাজি, সাম্প্রদায়িক প্রচারণা এগুলো থেকে মুক্ত করে অবাধ নিরপেক্ষ করতে হবে৷ পাকিস্তান আমলে আমি নিজেই লড়াই করেছি, সর্বজনীন ভোটাধিকার দিতে হবে৷ এক লোক এক ভোট চাই৷ এরশাদের আমলেও আমরাও দেশের চার প্রান্ত থেকে হেঁটে ঢাকায় এসে মহাসমাবেশ করেছি৷ আমি নিজেই ২১ দিন হেঁটে খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছি৷ অন্য চার নেতা চার প্রান্ত থেকে এসেছেন৷ শ্লোগান ছিল আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব৷ আমি যেটা বলতে চাই, ফেরেশতাদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন করলেও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যাবে না৷ যদি নির্বাচনের সিস্টেমটা না বদলান৷
আসলে কী রাষ্ট্রপতির বিবেক, বুদ্ধি, শিক্ষা, নৈতিকতা প্রয়োগের কোন সুযোগ আছে? নাকি বর্তমান সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির পদটা শুধুই আলঙ্কারিক-শোভাবর্ধণকারী?
আমাদের সংবিধান অনুযায়ী তাই৷ আমরা ব্রিটিশ সিস্টেম অনুসরণ করি৷ এখানে তো মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা৷ এখানে তো ৭০ ধারা নিয়ে বড় রকমের প্রশ্ন আছে৷ সংসদের কাছে সরাসরি জবাবদিহি করতে হয় না৷ আরও কিছু প্রশ্ন আছে৷ কিন্তু সেগুলো ভিন্ন আলোচনা৷
রাষ্ট্রপতির পদটাকে কী আরও গ্রহণযোগ্য করা যায়?
এটা করার তো দরকার নেই৷ এটা করলেই বা কী হবে? তাতে রাষ্ট্রপতি একরকম সিদ্ধান্ত দিলেন, প্রধানমন্ত্রী আরেক রকম সিদ্ধান্ত দিলেন, দু'টো পাওয়ার সেন্টার আলাদা করলে দেশে নতুন আরেক ধরনের বিশৃঙ্খলা হবে৷ আমাদের সেন্টার অব পাওয়ার একটাই থাকা উচিৎ৷ সেটা জবাবদিহিতামূলক এবং জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা থাকতে হবে৷ পাওয়ারকে ডিসেন্ট্রালাইজ করে একেবারে নিচ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে৷ কোন গ্রামে স্কুল কমিটিতে কে থাকবে, কালভার্ট কোথায় হবে সেটা সংসদ সদস্যদের একেবারে নিষিদ্ধ করে দিতে হবে৷ এগুলো লোকাল বডিগুলো দেখবে৷ তারা শুধু আইন প্রণয়ন ও কেন্দ্রীয় সরকারের কার্য তদারক করবে৷ এখন তো একেকজন একেকটা এলাকার জমিদার হয়ে গেছেন৷
অতীতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের চা চক্রের আয়োজন হতো, এই চা চক্র থেকেই অনেক সমস্যার সমাধান হতো৷ এখন এই ধরনের আয়োজন কেন এখন হয় না?
এটা আইয়ুব খান বা জিয়াউর রহমান বা এরশাদের সময়ের কথা হবে৷ কারণ তখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা ছিল৷ তখন তো রাষ্ট্রপতির সঙ্গেই আলোচনা হবে৷ রাজনৈতিক আলোচনা করতে হলে যার হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা তার সঙ্গেই তো আলোচনা হওয়া উচিৎ৷ সেটা আরও ঘন ঘন হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি৷ এতবড় করোনা হয়ে গেল প্রধানমন্ত্রী তো আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকলেন না৷ আমি নিজেই তো প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সবার সঙ্গে কথা বলেন৷ কয়েক লাখ স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করে সাত দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে নামিয়ে দেন৷ কিন্তু উনি তো পদক্ষেপ নিলেন না৷
রাষ্ট্রপতি যে কাউকে ক্ষমা করতে পারেন, সংবিধান তাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে৷ কিন্তু রাষ্ট্রপতি যাদের সাধারণ ক্ষমা করছেন, তাদের মধ্যে চরম বিতর্কিত মানুষও থাকেন৷ যা সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে প্রত্যাশা করেন না৷ তারপরও কেন রাষ্ট্রপতিকে এটা করতেই হয়?
রাষ্ট্রপতি তো নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী এটা করেন না বা করতে পারেন না৷ তাকে তো প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হয় এবং সেই পরামর্শ অনুযায়ী করা বা না করাটা নির্ধারিত হয়৷ এটা আমাদের সংবিধানের চরিত্র৷ এটা তো সমস্যা না, সমস্যাটা হচ্ছে যিনি সিদ্ধান্তটা নিচ্ছেন তিনি জবাবদিহি করতে বাধ্য কিনা? গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কিনা৷ আপনি একাদশ নির্বাচনের আগের নির্বাচনটা খেয়াল করেন, সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪জন নির্বাচিত হয়ে গেলেন৷ অথচ সরকার গঠনের জন্য ১৫০টি আসন দরকার৷ এখন এরা তো বলতে পারত, অন্য আসনে ভোট হোক আর না হোক আমরা সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট৷ তার মানে কী, একটা লোকও ভোট দিল না, কিন্তু সরকার হয়ে গেল৷ ভোটাধিকার হরণ নানাভাবে হয়, আইয়ুব খানও করেছিল মৌলিক গণতন্ত্র চালু করে, জিয়াউর রহমান হ্যাঁ-না ভোটের মাধ্যমে৷ সেখানে তারা দেখিয়ে দিল ৯৮ পারসেন্ট ভোট পড়েছে৷ আর এরশাদ এগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন৷ এখন আরেকভাবে হচ্ছে৷ গণতন্ত্রের কবর দিয়ে দেওয়া হয়েছে৷
এখন তো আইন করা সম্ভব না? তাহলে কীভাবে একটা ভালো নির্বাচন কমিশন হতে পারে?
আমি তো মনে করি, আইন করা সম্ভব৷ কে বলল সম্ভব না৷ পঞ্চম সংশোধনীতে কয়দিন লেগেছিল? সাত দিনে সম্ভব৷ এরশাদ চলে যাওয়ার পর সাহাবুদ্দিন আহমেদকে দায়িত্ব দেওয়া হল তখন তো সংশোধনী করা হল৷ সেটা কী? এই ক্ষেত্রে একটা ব্যতিক্রম হবে প্রধান বিচারপতি পাবলিক অফিসে দায়িত্ব পালন করার পরও তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে আবার ফেরত যেতে পারবেন৷