ব্যাংক খাতে লুটপাট নীতি
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩তারা মনে করেন, সাধারণ মানুষের টাকা লুটপাটের সহজ উপায় হলো ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা নেয়া এবং ফেরত না দেয়া৷
বিশ্লেষকেরা এটাকে বলছেন টাকা লোপাটের আনুষ্ঠানিক কৌশল৷ আর দেশের এই অর্থ যারা লুট করেন তারা সেটা আবার পাচার করে দেন দেশের বাইরে৷ কিন্তু এর জন্য থাকতে হবে রাজনৈতিক ক্ষমতা, হতে হবে সপরিবারে ব্যাংকের পরিচালক অথবা থাকতে হবে প্রভাবশালী ও শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক৷
এই সময়ে ব্যাংকের তারল্য সংকট, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করে ব্যাংক চালানো, প্রবলেম ব্যাংক এই সবকিছুর মূলে রয়েছে এই খেলাপি ঋণ৷ কারণ এখান থেকেই সব সংকটের উৎপত্তি৷ ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আমানতের বিপরীতে কম সুদ দিচ্ছে৷ আর গ্রাহকরা সেই কারণে ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দিয়েছেন৷ যা থেকে আসছে তারল্য সংকট৷ তারও মূলেও এই খেলাপি ঋণ৷ কারণ খেলাপি ঋণের যে ক্ষতি তা কম সুদ দিয়ে পুষিয়ে নিতে চায় ব্যাংক৷ একই সঙ্গে এই পরিস্থিতি ব্যাংকে আস্থার সংকট তৈরি করে৷ বাংলাদেশে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা৷
সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘এই সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন খেলাপি ঋণ ছিলো ২২ হাজার কোটি টাকা৷ এখন সেটা এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে৷ এর মূল কারণ ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব৷ এখানে সত্যিকারের ঋণখেলাপি আর ইচ্ছকৃত ঋণখেলাপি আলাদা করা হয়নি৷ যারা ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে ঋণখেলাপি হয়েছেন তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয়নি৷’’
তার কথা,‘‘ব্যাংক খাতে যে সংস্কার করার কথা ছিল তা করা হয়নি৷একই পরিবারের চারজন একটি ব্যংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারছেন৷ আগে ছিলো সর্বোচ্চ দুইজন৷ আর আগে পরিচালকরা সর্বোচ্চ ৯ বছর থাকতে পারতেন সেটা বাড়িয়ে ১২বছর করা হয়েছে৷’’
‘‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো ব্যাংকগুলোর অভিভাবক ৷ আমরা দেখছি তাদের নজরদারি ঠিকমতো হয় না৷ বছরের পর বছর ঋণের এই খেলাপি চলছে৷ কিন্তু কোনো সুরাহা হচ্ছে না৷ আমরা কমিশন করে রিপোর্ট দিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য বলেছি৷ কিন্তু হচ্ছে না,’’ বলেন এই অর্থনীতিবিদ৷
গত জুনের হিসাব বলছে বাংলাদেশের ১১টি ব্যাংক ব্যাংকে মোট ৩৩ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি রয়েছে৷ এসবের মধ্যে আছে কৃষি ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক৷ এর পাঁচটি ব্যাংকই হলো রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক৷ গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবলেম ব্যাংক হিসেবে ১০টি ব্যাংককে চিহ্নিত করে৷ যদিও নাম প্রকাশ করা হয়নি৷ এরপর এই ধরনের নয়টি দুর্বল ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ করে বাংলাদেশ ব্যাংক৷
বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম আর লুটপাটের সর্বশেষ উদাহরণ ইসলামী ব্যাংক৷ পরিস্থিতি সামলাতে তাই ইসলামী ব্যাংকের শাখাগুলোর ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে৷ মন্দার মধ্যেই গত বছর ইসলামী ব্যাংকে সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে৷ এস আলম গ্রুপ একাই ওই ব্যাংক থেকে নিয়মের তোয়াক্কা না করে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়৷ এস আলম গ্রুপের কর্ণধারেরাই আবার ব্যাংকটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত৷ ব্যাংকটিকে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ধার দিয়ে সচল রাখাছে৷ ইসলামি ধারার আরো কিছু ব্যাংক এখন সংকটে রয়েছে৷ ইসলমি ব্যাংকসহ শরিয়া ভিত্তিক ছয়টি ব্যাংক এখন বাংলাদেশ ব্যাংককে জরিমানা দিচ্ছে প্রতিদিন৷ নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে না পারায় তাদের এই জরিমানা গুণতে হচ্ছে৷ ইসলামী ব্যাংক ছাড়া অন্য পাঁচটি ব্যাংক হলো: সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক৷ এর মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলো এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন৷ এসব ব্যাংক গত বছরের ডিসেম্বর থেকে তারল্য ঘাটতিতে রয়েছে৷
ব্যাংকের টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে অবৈধ উপায়ে৷ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র এই ব্যাংকগুলো দুর্বল হওয়ায় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে এর প্রভাব পড়ছে৷ বিনিয়োগ বাড়ছে না৷ ফলে কর্মসংস্থান বাড়ছে না৷
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নুরুল আমিন বলেন,‘‘ব্যাংককে হতে হবে ব্যবসায়ী বান্ধব৷ তারা যদি ব্যবসায়, শিল্পে সহায়তা করে তাহলে এই খাত শক্তিশালী হবে৷ অর্থনীতি লাভবান হবে৷ রাজনৈতিক বিবেচনায় তারা কাজ করে বা করতে বাধ্য হয়৷ ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ছে৷ ব্যাংকগুলো দুর্বল হচ্ছে৷ যারা খেলাপি ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা লুটে নিচ্ছে, দেশের বাইরে পাচার করছে৷ তাদের আমরা শাস্তির আওতায় আসতে দেখিনি৷’’
‘‘আর এখনআত্মীয়-স্বজনেরা মিলে ব্যাংক চালায়৷ তারা নিজেরা ইচ্ছেমত ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়৷ আবার অন্যদের ঋণ পেতে সহায়তা করে তাদের ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়৷ এটা এখন ঋণ লেনদেনের ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে৷ আর যেটা অনেক ক্ষেত্রেই লুটপাট,’’ বলেন এই ব্যাংকার৷
তার কথা,‘‘বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুটা মনিটরিং করে৷ কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ব সব ব্যাংকে তারা মনিটরিং করতে পারে না৷ আবার প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণে কিছু করতে পারে না৷ এখানে মূল বিষয়টি হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব৷’’
বাংলাদেশে এখন মোট ৬১টি তফসিলি ব্যাংক রয়েছে৷ এর মধ্যে ৪৩টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক৷ এছাড়া বিশেষায়িত, তফসিলের বাইরের ও বিদেশি ব্যাংক আছে৷ নতুন আরো পাঁচটি ব্যাংককে অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷ জিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ারও কাজ শুরু হয়েছে৷
সিরডাপের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হেলালউদ্দিন মনে করেন, ‘‘সুশাসনের অভাবে চালু ব্যাংকগুলোর দুরাবস্থা৷ এটা অর্থনীতির যে খারাপ অবস্থা তারই প্রতিফলন৷ সাধারণ মানুষের আমানত ঝুঁকির মুখে আছে৷ তাই যে ব্যাংকগুলো আছে সেখানে আগে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি৷ নতুন ব্যাংকের অনুমতি দিয়ে নতুন প্রবলেম ব্যাংক সৃষ্টির কোনো মানে হয় না৷’’
ব্যাংকগুলোর এই পরিস্থিতির কারণে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দিয়েছে৷ সাধারণভাবে দেশে মোট অর্থের ১০-১২ শতাংশ মানুষের হাতে নগদ থাকার কথা৷ এই অর্থ দিয়ে তারা দৈনন্দিন চাহিদা ও বিভিন্ন কেনাকাটা করেন৷ কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এখন মানুষের হাতে নগদ অর্থ ১৬ শতাংশ৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত জুন শেষে মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ১০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা৷ সাধারণভাবে দুই লাখ ৫৫ হাজার থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা মানুষের হাতে নগদ থাকে৷ এর আগে কয়েকটি ব্যাংকের জালিয়াতির তথ্য সামনে আসার পরও গত ডিসেম্বরে মানুষের হাতে ছিল সর্বোচ্চ দুই লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা৷
আর ব্যাংকিং খাতে এখন অতিরিক্ত তারল্য আছে তিন হাজার ৯০৯ কোটি টাকা৷ এক বছর আগে অতিরিক্ত তারল্য ছিলো দুই লাখ তিন হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা৷
মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘‘রাজনৈতিকভাবে ভাবলে মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে৷ অর্থনেতিকভাবে ভাবলে ব্যাংকে টাকা রাখা কেউ কেউ অর্থনৈতিকভাবে লাভের মনে করছেন না৷ ব্যাংকের সাথে কাস্টোমারের সম্পর্ক হলো আস্থার৷ সে তার ইচ্ছে মতো টাকা জমা দিতে পারবে, ইচেছ মত তুলতে পারবে৷ কাউন্টারে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনি টাকা তুলছেন কেন তাহলেই সমস্যা৷’’
তার কথা,‘‘ব্যাংকখাত যত কম নেগেটিভ নিউজ তৈরি করবে তত তার ওপর মানুষের আস্থা থাকবে৷ এখন ঋণ খেলাপি, অর্থ পাচারসহ নানা ধরনের খবর ব্যাংকের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি করে৷ এগুলো ঠিক করতে না পারলে ব্যাংকগুলোকে আস্থার জায়গায় নেয়া কঠিন৷’’
ড. হেলালউদ্দিন বলেন, ‘‘কীভাবে সম্ভব যে বাংলাদেশে একজন ব্যক্তি সিংহভাগ ব্যাংকের মালিক হয়ে গেল৷ এর ফলে তার ওপর এই খাতটি এককভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ল৷ তিনি চাইলে অনেক কিছু ব্যাংক খাতে প্রভাবিত করতে পারেন৷ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াও কঠিন৷ কারণ ব্যবস্থা নিলে যদি আরও অস্থিরতা তৈরি হয়৷’’
তার কথা,‘‘ব্যাংক খাতে এই যে লুটপাট এর ভাগ ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত আরও অনেকে পাচ্ছেন৷ ফলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না দিয়ে উল্টো সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে৷ এই অবস্থা না হলে ব্যাংকে ১০০ টাকা রেখে আমি কমপক্ষে ১৫ টাকা মুনাফা পেতাম৷ এখন পাই ছয়-সাত টাকা৷ কারণ তারা আমাকে কম মুনাফা দিয়ে লুটপাটের ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে৷’’