ভরশূন্য উড়াল বিমানেই, বিজ্ঞান শিক্ষায় অগ্রগতি
৩ ডিসেম্বর ২০১১বিজ্ঞানের তরুণ ছাত্রছাত্রীদের জানার আর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য বিজ্ঞানের বহুবিধ ব্যবস্থা রয়েছে৷ এই যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞান উৎসুকদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল মহাশূন্যে না গিয়েও মহাকাশযানের মধ্যে থাকার মত পরিবেশের৷ সেটাকে বেশ বাস্তবসম্মত করার জন্য বিশেষ বিমানে উড়িয়ে আকাশের মধ্যেই এই ব্যাপারটির আয়োজন করা হয়েছিল৷
মোট ত্রিশজন ক্লাসরুম পেশাদারকে বেছে নেওয়া হয়েছিল এই বিশেষ উড়ালে অংশগ্রহণ করতে৷ তাঁরা সকলেই বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী এবং সকলেই তরুণ বয়স্ক৷ উৎসাহে কারোরই কোন ঘাটতি নেই৷ কিন্তু তারপরেও, ব্যাপারটা তো তত সোজাও নয়! মহাশূন্যের মাধ্যাকর্ষণহীন যে ভাব, তেমনটা জীবনে প্রথমবার বোধ করতে হলে তার জন্য শারীরিক প্রস্তুতি তো বটেই মানসিক প্রস্তুতিও অনেকখানি নাহলে মুশকিল! এই যেমন শিক্ষিকাদের একজন, মিশেল লুকের কথাই ধরা যাক৷ বিমান আকাশে উড়তে তখনও বেশ কয়েকঘন্টা বাকি রয়েছে৷ মিশেল ইতিমধ্যেই তাঁর নীলরঙা জাম্পস্যুটটি শরীরে চড়িয়ে নিয়েছেন অন্য সকলের মতই৷ সাংবাদিকদের তিনি বললেন, ‘‘অনেক ভিন্নরকমের সব ঘটনা ঘটবে যে তা আমি জানি, জীবনে যা কখনও করিনি, তেমন অভিজ্ঞতা হতে চলেছে, তাও জানি৷ আমি ভীষণ উত্তেজিত৷ কিন্তু সত্যি কথা বলছি, ভয় ভয় লাগছে আমার৷ নার্ভাস লাগছে৷''
নার্ভাস লাগার কথাই তো৷ ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচ আইল্যান্ড বিমানবন্দর থেকে বিশেষ যে দোতলা বিমানে এই ত্রিশজনকে চড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল, সে বিমানের পেটের ভিতরে বিশেষ সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ প্রথম ব্যবস্থা হল, সে বিমানের অভ্যন্তর প্রয়োজনে বায়ুশূন্য করা যাবে৷ তাছাড়া আকাশে ওড়ার সময় সে বিমানটি খাড়া অবস্থায় অবস্থান করতে পারে, অনেক উঁচু থেকে জঙ্গি বিমানের মত একেবারে নাক বরাবর ডাইভ মারতে পারে, ইত্যাদি৷ আর বিমান যখন এই সব করছে, স্বভাবতই তার আরোহীদের যে কেমন অবস্থা হবে, তা আন্দাজ করাই যায়৷ সেইসব প্রতিকূলতা আরোহীরা সামলাতে পারবেন তখনই যখন বিমানের মধ্যে রয়েছে বায়ুশূণ্য ব্যবস্থা এবং নেই কোন মাধ্যাকর্ষণ৷ ফলে মহাশূণ্যের স্পেস স্টেশনে যেমন নভোচারীরা ভেসে ভেসে বেড়ান, ঠিক তেমন করেই এই বিমানের আরোহীরা তখন ভেসে বেড়াতে পারবেন৷ আর তাতে সাহায্য করবে বিমানটির বিশেষ কৌণিক অবস্থান৷
৪৫ ডিগ্রি কৌণিক অবস্থানে বিমান যখন শূন্যে রয়েছে, সেই সময়টার কথাই ব্যাখ্যা করছিলেন, এই বিশেষ উড়ালের পরেই তরুণ বিজ্ঞান উৎসাহীরা৷ ব্যাপারটা হল কেমন? মাটি থেকে ৭৬০০ মিটার ওড়ার পর বিমানের পাইলট বিমানের এঞ্জিন বন্ধ করে দেন৷ এরপর গতিবেগের সঙ্গে তাল রেখে বিমান আরও ১০০০ মিটার উঠে যায়, তারপরেই শুরু হয় তার সোজা নাক বরাবর নীচের দিকে পড়তে থাকা৷ হু হু করে বিমানটি যখন নীচের দিকে নেমে চলেছে, তার এঞ্জিন বন্ধ, সেই হল তুঙ্গ মুহূর্ত৷ সর্বমোট মাত্র বিশ সেকেন্ড৷ এই বিশ সেকেন্ড সময়টাই আসল৷ যখন বিমানের ভিতরটা বায়ুশূন্য হয়ে গেছে, সকলের মাথা নেমে গেছে নীচের দিকে, আর শরীরের যাবতীয় তরল পদার্থ মাথায় গিয়ে ভর করছে৷ এই বিশ সেকেন্ড সময় পার হওয়ার পর আবার পাইলট বিমানের এঞ্জিন চালু করে দেন৷ স্বাভাবিক চেহারায় ফিরিয়ে আনেন বিমানটিকে৷ তারপর এমন করেই আরও বেশ কয়েকবার একই পদ্ধতি অবলম্বন করে মহাকাশযানের মধ্যে থাকার মত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফিরে এলেন বিজ্ঞান উৎসাহীরা৷
পুরো এই উড়ালটিকে ভিডিও রেকর্ড করার ব্যবস্থা ছিল৷ ফলে এবারে মাটিতে নেমে আসার পর এই ভিডিও টেপ চালিয়ে দেখে দেখে বহুকিছু শিখতে পারবে অন্যরাও৷ ভবিষ্যতে মহাকাশ বিজ্ঞানের সঙ্গে যারা যুক্ত হতে চায়, বা এই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহী তাদের জন্য তো বটেই, বিশেষ এই উড়ালের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যাবে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ তার মধ্যে রয়েছে চিকিৎসাশাস্ত্রের নানান ব্যাপারস্যাপারও৷
বিশেষ এই উড়াল এবং তার মাধ্যমে পরীক্ষানিরীক্ষার আয়োজন যারা করছে, সেই গামম্যান ফাউন্ডেশনের তরফে ভবিষ্যতেও এ ধরণের উড়ালের আয়োজন করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে৷ ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, অভূতপূর্ব উৎসাহ এবং সাড়া পেয়েছে তারা এই বিশেষ পরীক্ষার পর৷ বিজ্ঞানে উৎসাহী একাধিক স্কুল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে নিয়মিত৷ তাই গামম্যান ফাউন্ডেশন চাইছে এ ধরণের আরও গবেষণামূলক উড়ালের আয়োজন তারা ভবিষ্যতে করতে চায়৷
আসলে শুধুমাত্র ক্লাসে বসে বিজ্ঞানের শুকনো তত্ত্ব আর থিওরি মুখস্থ করলেই যে বিজ্ঞান শেখা যায়না, এই উড়ালের আয়োজন তার থেকেই করা৷ জানিয়েছেন, গামম্যান ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট সান্ড্রা জে এভারস ম্যানলি৷ তাঁর বিশ্বাস, বিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিকটির বিষয়েও ছাত্রছাত্রীদের সম্যক ধারণা পাওয়া দরকার৷ তার ফলে শিক্ষায় উৎসাহ যেমন বাড়বে, তেমনই শিক্ষার বনিয়াদটিও হয়ে উঠবে শক্তপোক্ত৷
কথাটা ভুল নয়৷ মহাশূন্যে যাওয়ার সুযোগ সকলের জীবনে ঘটা সম্ভব নয়৷ কিন্তু তার অভিজ্ঞতাটার একটা আন্দাজ পেলে সে বিষয়ে উৎসাহ বেড়ে যাবেই৷ আর তার মধ্যে থেকেই উঠে আসবে কিছু মহাকাশ গবেষক, মহাকাশ বিজ্ঞানী এবং হয়তো নতুন প্রজন্মের মহাকাশচারীরাও৷
প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক