1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নিয়ে ভাবনা, ভোটারদের নিয়ে নেই?

ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম৷
আরাফাতুল ইসলাম
৫ জানুয়ারি ২০২৪

জাতীয় নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব কি ভোটারের পাওয়া উচিত নয়? স্বাভাবিক চিন্তায় অবশ্য সেটাই হওয়া উচিত৷ কিন্তু দেশে দেখছি নির্বাচন বিষয়ক আলোচনায় দুটো নাম: ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ ভোটাররা কোথায়?

https://p.dw.com/p/4atqL
বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও যে বিষয়টি তীব্রভাবে অনুপস্থিত তা হচ্ছে ভোটারের মন জয় করে তাকে ভোটকেন্দ্রে নেয়ার চেষ্টা।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও যে বিষয়টি তীব্রভাবে অনুপস্থিত তা হচ্ছে ভোটারের মন জয় করে তাকে ভোটকেন্দ্রে নেয়ার চেষ্টা।ছবি: Arafatul Islam/DW

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি আরো নিষেধাজ্ঞা দেবে, আর ভারত কেন ‘‘শুধু আওয়ামী লীগে'' মজেছে মনে করা হচ্ছে- সেই আলোচনায় আসার আগে গত কয়েকদিন ভোটারদের সঙ্গের আলাপ জানিয়ে নেই৷

ঢাকা শহরের নানা কোনায় গত কয়েকদিন কথা বলেছি বেশ কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে৷ তাদের কেউ ঢাকার ভোটার, কেউবা ঢাকার বাইরের ভোটার৷

মোহাম্মদপুরে এক পোশাক কারখানার সামনে কথা হয় স্মৃতি রানী দাসের সঙ্গে৷ আড়াই বছর ধরে পোশাক শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তিনি, বয়স ২৪ বছর৷ দেশের বাড়ি সিলেটে৷ ঢাকায় থাকেন স্বামী, সন্তান এবং শ্বশুড়শ্বাশুড়িসহ একসঙ্গে৷ তার স্বামীও পোশাক কর্মী৷

স্মৃতি মাসে বেতন পান ৮,৭০০ টাকা৷ এই বেতন কর্মীদের যে ন্যূনতম মজুরী ডিসেম্বর অবধি ছিল, সেই ৮ হাজার টাকার সামান্য বেশি৷ চলতি মাস থেকে পোশাক খাতের কর্মীদের ন্যূনতম মজুরী ১২,৫০০ টাকা চালু হওয়ার কথা৷

স্মৃতি আশা করছেন, চলতি মাস থেকে বেতন বাড়বে তার৷ তবে সেই বাড়তি বেতনেও তার নিত্যদিনের চাহিদা পূরণ হবে এমন আশা করছেন না তিনি৷ কারণ বেতন বাড়ার অনেক আগে থেকেই দ্রব্যমূল্য তরতরিয়ে বাড়ছে৷

‘‘এক কেজি চালের দাম ষাট থেকে সত্তর টাকা, সবজির দাম বাড়তি, তেলের দাম বাড়তি - সবকিছুইতো বাড়তি৷''

সরকার নির্ধারিত মজুরিতে জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে স্মৃতি রানী দাসের মতো গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য।
সরকার নির্ধারিত মজুরিতে জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে স্মৃতি রানী দাসের মতো গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য।ছবি: Arafatul Islam/DW

দুপুরের খাবার বিরতি থেকে ফেরার সময় কথা হচ্ছিল স্মৃতির সঙ্গে৷ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে ফেরার তাড়া তার৷ আবার কিছু কথা বলার আগ্রহও রয়েছে৷ তার সংসারের অবস্থা বোঝাতে গিয়ে বলেন, ‘‘পরিবারে তো অনেকে আছে৷ ১২,৫০০ টাকায় হয় না ফ্যামিলি চালানো৷ একটা সন্তানরে লেখাপড়া করাইতে অনেক খরচ৷ ওর মা-বাবা আছে৷ তাদেরও তো চালানে লাগে৷''

স্মৃতি জানেন, কিছুদিন আগে পোশাক শ্রমিকরা সর্বনিম্ন মজুরী ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন৷ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ খরচ বৃদ্ধিসহ সবমিলিয়ে তাদের জীবন কঠিন হয়ে উঠেছে বলে এমন বেতনের দাবি তাদের৷ কিন্তু তাদের সেই দাবি পূরণ হয়নি৷ আপাতত তাই সরকার যা দেবে সেটা মেনে নিয়ে মানিয়ে চলা ছাড়া ভিন্ন কিছু দেখছেন না স্মৃতি৷

তিনি বলেন, ‘‘চলা না চলায় তো কিছু করার নেই৷ সরকার যেটা দিয়েছে সেটাই মেনে নিতে হবে৷''

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে৷ কিন্তু সেই খাতের কর্মীদের চাহিদা অনুযায়ী বেতন বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের অনীহা রয়েছে বলে মনে করেন এই খাতের অনেক কর্মী৷ মোহাম্মদপুরে আরো কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়৷ তারা সবাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কথাই বললেন সবার আগে৷

আর সাত জানুয়ারির ভোট নিয়ে পেয়েছি মিশ্র প্রতিক্রিয়া৷ কেউ কেউ বললেন ভোট দিতে যাবেন, কেউ বললেন ভোট দেয়া বা না দেয়ায় কিছু যায় আসে না৷ একজন জানালেন বেঁচে থাকতে হল, সমাজে মিশতে হলে ভোট দিতে না গিয়ে নাকি উপায় নেই!

পোশাককর্মী জোহোরা অবশ্য দিলেন ভিন্ন আরেক তথ্য৷ তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচনে আর কী করবো, এখন তো এই অফিস (তিনি যে পোশাক কারখানায় কাজ করেন) থেকে আজকে মাইকিং করে কইয়া দিছে যে ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি নিয়া আইসো৷ দিয়ে দেবো, ভোট এমনিতেই হয়ে যাবে৷''

একজন পোশাক কর্মী তার কারখানায় ভোটার আইডি কার্ড জমা দিয়ে দিলেই তার ভোট হয়ে যাবে- এই তথ্য আগে শুনিনি৷ তবে নির্বাচন যত ঘনাচ্ছে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো বা কমানো নিয়েও নানা কথা শোনা যাচ্ছে৷ বিরোধীদলবিহীন কার্যত একতরফা নির্বাচনে ভোটার হার একটা ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে৷ কোন যুক্তিতে এমন ভাবনা সেটা অবশ্য আমি বুঝতে পারছি না৷ কিন্তু আলোচনাটা রয়েছে৷ 

ঢাকায় একটি হোটেলে বৃহস্পতিবার বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও মিশনপ্রধান এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের ভোটের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়েছেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। সেখানে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা জানতে চেয়েছেন যে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে সরকার বা নির্বাচন কমিশন থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে কিনা৷

স্বাভাবিকভাবেই কমিশন এরকম চাপ দেয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছে৷ তবে গণমাধ্যম ইতোমধ্যেই জানাচ্ছে যে যারা বয়স্কভাতাসহ নানা ধরনের সামাজিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন তাদেরকে ভোটকেন্দ্রে না গেলে সেসব সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে৷ এরকম সুযোগ-সুবিধা পাওয়া মানুষের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়৷ পাশাপাশি নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীদের কেউ কেউ ভোটারদের এই বলে হুমকি দিচ্ছেন যে ভোটকেন্দ্রে না গেলে হাতপা ভেঙ্গে দেয়া হবে!

এদিকে, বিরোধী দল ভোটারদের প্রতি ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট বিতরণ করছে রাখঢাক বজায় রেখে৷  হঠাৎ তাদের কয়েকজনকে রাজপথে দেখা যায়৷ ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর দলটির ২৩ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তাদের মধ্যে দলটির অনেক শীর্ষ নেতাও রয়েছেন৷ অনেকে আবার পুরনো মামলায় দ্রুত সাজা পেয়েছেন৷ রাজপথে সহিংসতায় প্রাণ গেছে বেশ কয়েকজন কর্মীর, কয়েকজন মারা গেছেন কারাগারে৷

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত কয়েক সপ্তাহে সরকারের যে পরিমান দমনপীড়নের মুখে পড়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, অতীতে স্বাধীন বাংলাদেশে কখনই এতটা ঘটেনি৷

নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি পূরণ না হওয়ায় এমন দমনপীড়নের মুখে আগেভাগেই নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল৷ অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভোটে থাকা জাতীয় পার্টির একের পর এক প্রার্থীও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন শেষ মুহূর্তে এসে৷  

বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও যে বিষয়টি তীব্রভাবে অনুপস্থিত তা হচ্ছে ভোটারের মন জয় করে তাকে ভোটকেন্দ্রে নেয়ার চেষ্টা, তার সামনে প্রকৃত অর্থে প্রতিনিধি বাছাইয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা৷ গত নির্বাচন নিয়ে মূল অভিযোগটা ছিল ভোটের আগের রাতে নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যালট বাক্স পূর্ণ করেছে ক্ষমতাসীনরা৷ ভোটের দিন অনেক ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটা দিতে পারেননি বলেও অভিযোগ করেছেন৷

এবার বিএনপি না থাকার পরও সেই পরিস্থিতির শঙ্কা করেছেন কিছু ভোটার৷ ঢাকার গাবতলী বাস স্টেশনে কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি৷ তাদের একজন মোসাম্মৎ মরিয়ম আক্তার৷ বরগুনার বেতাগির ভোটার তিনি৷ জানালেন, ভোটার হলেও ভোট দিতে পারেননি গতবার৷ কারণ ভোট এমনিতেই হয়ে যায়৷

মরিয়মের মতো এই মত অনেকের৷ সাত জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট দিলেও যে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না, বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছেন তারাই ক্ষমতায় থেকে যাবেন সেটা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই৷

তারপরও ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি বাড়িয়ে ক্ষমতাসীনরা কী অর্জন করতে চায়, বা বিরোধী দল তাদের ভোটকেন্দ্রে না যেতে বলে কী বোঝাতে চায় বলা দুষ্কর৷

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ঘুরিয়েফিরিয়ে ঢাকায় যে আলোচনাটা সবচেয়ে বেশি দেখি সেটা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের ভূমিকা৷

আওয়ামী লীগের নানাপর্যায়ের নেতা-কর্মীরাসহ সংবাদমাধ্যমের একটা অংশ বোঝানোর চেষ্টা করে যে ‘‘ভারত আওয়ামী লীগের পাশে রয়েছে''৷ ফলে তারা নির্বাচন নিয়ে যাই করুক সমস্যা হবে না৷ ভারত সরকারও মাঝেমাঝে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যা বলে সেটার ব্যাখ্যা বাংলাদেশের জনগণের সামনে এভাবেই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়৷

অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত বেশ কয়েকমাস ধরে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের দিকে জোর দিয়ে আসছে৷ এর ব্যতয় হলে আগাম ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণাও দিয়েছে দেশটি৷ ইতোমধ্যে সেই নিষেধাজ্ঞার আওতায় সরকার, বিরোধীদলসহ কয়েকক্ষেত্রে প্রয়োগও করা হয়েছে৷

তবে, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে বেশ নিরব ভূমিকায় চলে গেছে দেশটি৷ পশ্চিমা যেসব রাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকারের নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে সরব ছিল, তারাও দৃশ্যত নিরব এখন৷

বাংলাদেশের মূলধারায় এখন পশ্চিমাদের এই নীরবতা এবং ভারতের ‘‘আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থনের'' কথাই বেশি চর্চিত হচ্ছে৷ সেখানে দেশের ভোটারদের চাওয়াপাওয়ার কথা তেমন একটা শুনিনা৷

অবস্থা এমন, দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ ভোটারদের হাতে নয়, বরং ভারত কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে গেছে৷ তাদের কূটনৈতিক শক্তির খেলায় যে এগিয়ে থাকবে বাংলাদেশের শাসক তারাই ঠিক করবে! ভোটারের প্রকৃত ভোট এখানে গুরুত্বহীন৷