ভারতে অশ্লীলতা আইন যেভাবে নারীর শরীর নিয়ন্ত্রণ করছে
১৬ জুলাই ২০২৩বিশ্বের ফ্যাশন জগতের পরিচিত এক নাম উফরি জাভেদ৷ মুম্বইয়ের নামকরা এই অভিনেত্রীকে ইন্সটাগ্রামে ৪০ লাখ মানুষ অনুসরণ করেন৷ টুইটারে তার ভক্ত আছে দুই লাখ৷
সমালোচনার মুখেও পড়েন তিনি৷ তার বিরুদ্ধে বিষোদগার – তিনি ‘আঁটসাট, খোলামেলা কাপড় পরেন৷'
যেমন, গত জানুয়ারিতে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির মহারাষ্ট্র প্রদেশের নেত্রী চিত্রা ওয়াগ মুম্বাই পুলিশেকে উফরির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানায়৷ চিত্রার দাবি, ‘জনসম্মুখে, রাস্তায় অশ্লীলতা করছেন উফরি৷'
এক টুইটে এই নারী নেত্রী বলেন, ‘‘যারা মুম্বইয়ের রাস্তায়, জনসম্মুখে শরীরকে কামুকভাবে উপস্থাপন করে চলাফেরা করে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত৷''
এর উত্তরে উফরি জাভেদ বলেন, ‘‘আরেক রাজনীতিবিদের কাছ থেকে পুলিশে অভিযোগ পেয়ে আমার নতুন বছর শুরু হলো৷ যতক্ষণ পর্যন্ত আমার শরীরের গোপন অঙ্গ দেখা না যায় ততক্ষণ আপনি আমাকে জেলে দিতে পারবেন না৷''
ডয়চে ভেলেকে এই অভিনেত্রী বলেন, ‘‘সৃষ্টিশীল হওয়ার কারণে এবং ফ্যাশন নিয়ে নিজের ভাবনার কারণে তাকে প্রায়ই ‘বেশ্যা, পর্নস্টার ইত্যাদিসহ নানা কথা শুনতে হয়৷'' এমনকি কেউ কেউ তাকে মারধরের এবং ধর্ষণের হুমকিও দিয়েছেন, জানান তিনি৷
‘‘সময়ের সাথে সাথে অশ্লীলতার সংজ্ঞা পাল্টাচ্ছে৷ আর তাই এমন কাথাবার্তা আসলে আমি গুরুত্ব দেই না৷ কিন্তু আমি যা শিখছি তা হলো, আমাদের সমাজে সব বিষয়ই নারীর লিঙ্গে গিয়ে শেষ হয়৷ সবসময়ই নারীদের দোষ৷ পুরুষেরা যা কিছু তা-ই করতে পারে৷''
অশ্লীলতা নিয়ে ভারতের আইন
ভারতের অশ্লীলতা আইন মূলত নৈতিকতা ও ভদ্রতা বা শিষ্টাচারের বিষয় থেকেই উদ্ভব৷ তবে অশ্লীলতা কীভাবে নির্ধারিত হবে তা নিয়ে অবশ্য ভারতের আদালতকেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়৷
দেশটির দণ্ডবিধির ২৯২ ধারায় অশ্লীলতা বলতে এমন বিষয়কে বোঝানো হচ্ছে, যা কামুকতাকে উসকে দেয়৷ আইনিভাবে কোনোকিছু অশ্লীল হলে তা বিক্রি করা, প্রকাশ করা বা বিতরণ করা নিষিদ্ধ৷ অশ্লীল অভিনয় এবং গানও দেশটির আইনে নিষিদ্ধ৷
এদিকে অশ্লীলতা আইনের আওতায় এখন ডিজিটাল পরিসরও৷ দেশটির ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট অনুযায়ী, অনলাইনে অশ্লীল কোনো কিছু প্রকাশ করা বা বিতরণ করা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়৷
দিল্লির আইনজীবি শ্রেয়া মুনোথ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ব্রিটিশ আমলে ভারতে অশ্লীলতা বিষয়ক আইন করা হয়৷
তিনি বলেন, বাকস্বাধীনতার বিষয়ে ভারতেই আইনে ‘নিয়ন্ত্রণমূলক ধারণা' রয়েছে আর অশ্লীলতা বিষয়ক আইন প্রায়ই নারীদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে৷
‘‘নারীদের বিষয়ে মামলায় আদালত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পোষণ করে থাকে৷ আদালতের ভাবনাটি এমন যে, নারীদের দেখভালের দায়িত্ব রাষ্ট্রের৷''
অশ্লীলতা বনাম বাক স্বাধীনতা
কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে এমন ঘটনাও অবশ্য আছে৷
দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যে অ্যাকটিভিস্ট রেহানা ফাতিমার বিরুদ্ধে ২০২০ সালে একটি মামলা দায়ের করা হয়৷ ফেসবুকে পোস্ট করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, ফাতিমার শিশু সন্তান তার অর্ধনগ্ন শরীরের উপর কিছু আঁকছে৷ ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা ছিল #বডিআর্টপলিটিকস অর্থাৎ শরীর, শিল্প রাজনীতি৷
যৌনতা এবং নগ্নতা নিয়ে সমাজে বিদ্যমান যে ট্যাবু তা চ্যালেঞ্জ করতেই ভিডিওটি বানানো হয়েছিল বলে জানান ফাতিমা৷ ফেসবুকে প্রকাশের পর ভিডিওটি নিয়ে ব্যাপক শোরগোল শুরু হয় এবং অনেকেই এটিকে ‘অশ্লীল এবং অভদ্র কাজ' বলে আখ্যায়িত করেন৷
তবে গত মাসে কেরালার আদালত ফাতিমার বিরুদ্ধে মামলাটি রহিত করে৷ একই সাথে অশ্লীলতা আইন, নৈতিকতা এবং নারী শরীর নিয়ে তীক্ষ্ণ মন্তব্য করে আদালত৷
বিচারক কাউসার এদাপ্পাগাথ বলেন, নারীরা নিপীড়নের শিকার, বৈষম্যের শিকার, বিচ্ছিন্ন এবং নিজেদের শরীরে ও জীবন নিয়ে নিজেরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে৷
শরীরের স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অংশ, ভারতের সংবিধান যার নিশ্চয়তা প্রদান করে৷ নগ্নতাকে ‘অশ্লীল, অভদ্র বা অনৈতিক হিসেবে দেখা যেতে পারে না৷'
পুরুষের অর্ধনগ্ন শরীর স্বাভাবিকভাবে দেখা হচ্ছে, কিন্তু নারীর শরীরকে দেখা হচ্ছে ভিন্নভাবে, বলেন তিনি৷
অশ্লীলতা বিষয়ে ভারতের আইন নিয়ে বিচারক এদাপ্পাগাথ বলেন, সমাজের নৈতিকতা ও কিছু মানুষের মনোভাবের কারণে কোনো ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করা যায় না৷
নিধি সুরেশ, নতুন দিল্লি/আরআর