1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে কন্যাভ্রুণ হত্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে

অনিল চট্টোপাধ্যায় নতুন দিল্লি
২ এপ্রিল ২০১৯

ভারতে কন্যাভ্রুণ হত্যার সংখ্যা দিন দিন যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে এক জাতীয় বিপর্যয়কারী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে৷ এর প্রধান কারণ গর্ভাবস্থায় ভ্রুণের লিঙ্গ পরীক্ষা৷ যদিও ভ্রুণের লিঙ্গ পরীক্ষা নিষিদ্ধ৷

https://p.dw.com/p/3G6Bv
প্রতীকী ছবিছবি: Getty Images/AFP/P. Paranjpe

কিন্তু মুনাফার লোভে বেসরকারি ক্লিনিকগুলিতে তা অবাধে চলছে৷ নারীবাদীদের মতে, এর পেছনে আছে সামাজিক ও আর্থিক কারণ৷

ভারতে নিয়মিত ও নিষ্ঠুরভাবে কন্যাভ্রুণ হত্যা করা হয়৷ কারণ আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষায় যখন জানা যায় গর্ভস্থ সন্তান পুত্র না কন্যা, তখন পরিবারের লোকজন কন্যাভ্রুণ নষ্ট করতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইতস্তত করেনা৷

ভারতে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বছরে ১০ লাখ কন্যাভ্রুণ হত্যা করা হয়৷ পৃথিবীর আলো দেখার আগেই সরিয়ে ফেলা হয়, কেড়ে নেওয়া হয় জন্মের অধিকার৷ তার মারাত্মক পরিণতি দেখতে হয় সমাজকে তথা দেশকে৷

ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতিতে নারী এখনও বৈষম্যের শিকার৷ ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, কন্যাভ্রুণ হত্যা এখন গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে৷ হরিয়ানা, পাঞ্জাব, দিল্লি, গুজরাট, হিমাচল প্রদেশ এবং ওড়িষা কোথায় নয়? প্রায় সব রাজ্যেই মোটামুটি একই অবস্থা৷ 

‘কন্যাসন্তান হত্যা আগেও যে হত না, তা নয়’

আগামী জনগণনায় বা সেন্সাসে জানা যাবে নারী-পুরুষের সঠিক অনুপাতে কতটা ফারাক৷ বর্তমান অনুপাত প্রতি হাজার পুরুষে ৮০০ বা তার কম নারী৷ এর পরিণামটা হতে চলেছে মারাত্মক৷ ছেলের বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রী পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠছে৷ বাড়ছে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, মেয়ে পাচার৷ বাড়ছে বাল্যবিবাহ, মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর হার৷

এখনই হরিয়ানার জাঠ সম্প্রদায়ের পাত্রকে (হরিয়ানায় ছেলে মেয়ের অনুপাতে ফারাক সবথেকে বেশি) পাত্রীর সন্ধানে যেতে হয় ভারতের দক্ষিণীতম রাজ্য কেরালায়৷ নিজেদের রাজ্যে রাতারাতি পাত্রীরা কি অদৃশ্য হয়ে গেছে? না, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কন্যাসন্তান হত্যার ফলেই এটা হয়েছে

‘মেয়ে মানেই নিরাপত্তাহীনতা'

এই প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপচারিতায় পশ্চিমবঙ্গের মহিলা কমিশনের প্রাক্তন প্রধান সুনন্দা মখোপাধ্যায় বললেন, পুত্রসন্তান পারলৌকিক কাজ, বংশরক্ষা, বৃদ্ধবয়সে দেখাশুনা ইত্যাদি করে থাকে৷ ‘‘এই বিষয়গুলি আমাদের সমাজের গভীরে প্রোথিত৷ দ্বিতীয় কারণ মেয়ে মানেই নিরাপত্তাহীনতা৷ মেয়ে ছোট হলেও একা বাড়িতে রেখে যাওয়া যায় না৷ স্কুলে পাঠিয়েও শান্তি নেই৷ সেখানেও নিরাপত্তার অভাব৷ বাস ড্রাইভার বা তাঁর সহযোগীর হাত থেকে রেহাই নেই৷ ব্যাড টাচের আশঙ্কা পদে পদে৷ স্কুলের প্রিন্সিপ্যালও এই নিয়ে মাথা ঘামান না৷ এমনকি পরিবারের লোকজনের হাতেও কন্যা সন্তান নিরাপদ নয়৷ কিন্তু এর বিহিত তেমন হয়না৷ হলে কদাচিত হয়,'' বলেন তিনি৷

ভ্রণের লিঙ্গ নির্ধারণ টেস্টের ফলে কন্যাভ্রুণ হত্যা বেড়ে গেছে, এটা মানতে রাজি নন সুনন্দা মখোপাধ্যায়৷ তিনি বলেন, ‘‘কন্যাসন্তান হত্যা আগেও যে হত না, তা নয়৷ জন্মের পরই অনেক কন্যাসন্তানকে মেরে ফেলা হত৷ মেরে ফেলতো বাড়ির লোকেরাই৷ জলে চুবিয়ে, বালিস চাপা দিয়ে৷ কন্যাসন্তান সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীটা এখনো কার্যত সেকেলে রয়ে গেছে, পালটায়নি৷ কন্যা সন্তানকে আর্থিক বোঝা বলে মনে করা হয় এখনো৷ পণপ্রথা যার অন্যতম কারণ৷ ১৯৬১ সালে পণপ্রথা নিষিদ্ধ আইন প্রণয়ন করা হয়৷ ১৯৮৫তে তা সংশোধন করা হয়৷ কিন্তু তা নিয়ে কোনো প্রচার নেই৷ অনেকেই জানে না, আইনের সাহায্যে কীভাবে তার মোকাবিলা করা যায়৷ পথ দেখাতে কেউ এগিয়ে আসেনি৷ না কোনো রাজনৈতিক নেতা, না কোনো সামাজিক নেতা৷ মেয়ে সন্তানকে বলা হয় দুহিতা, মানে যে দোহন করে নিয়ে যায়৷ কোথায় নিয়ে যাবে৷ নিশ্চয় কোনো পুরুষের ঘরে৷ সেই পুরুষটি যদি প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেন, তাহলে অন্য কথা৷''

কন্যাভ্রুণ হত্যা বেড়েছে ৪৯.২ শতাংশ

সেন্টার ফর সোস্যাল রিসার্চের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ভারতে প্রতি ২৫টি কন্যাসন্তানের মধ্যে একজনকে হত্যা করা হয় এবং ১৫ বছরের নীচে ১৫ লাখের বেশি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় প্রতি বছর৷ সম্প্রতি জাতীয় মহিলা কমিশন আয়োজিত এক আলোচনাচক্রের বিষয় ছিল, বন্ধ হোক উম্ব থেকে টুম্ব (গর্ব থেকে কবর) হিংসা৷

বক্তারা মনে করেন, গত কয়েক বছরে কন্যাভ্রুণ হত্যা বেড়েছে ৪৯.২ শতাংশ এবং ৫০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছর বা তার নীচে৷ সামাজিক সচেতনতা না বাড়াতে পারলে এর বিহিত করা মুশকিল৷

ম্যাগসাইসাই পুরস্কার বিজয়ী শান্তা সিনহা মনে করেন, শিশু শ্রমিকের চাহিদা প্রচুর, বিশেষ করে কন্যা সন্তানের৷ কারণ তাদের মজুরি কম৷ এদের সবথেকে বেশি চাহিদা কৃষিক্ষেত্রে৷

সাবেক মহিলা ও শিশু বিকাশ মন্ত্রী রেনুকা চৌধুরি বলেন, কন্যাভ্রুণ হত্যার হার বাড়ছে শহরাঞ্চলে সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে৷ ভ্রাম্যমান আল্ট্রাসাইন্ড ভ্যান এখন গ্রামে গঞ্জে পৌঁছে গেছে৷ ফলে গ্রামাঞ্চলে তার প্রভাব পড়েছে৷

আইন যা বলে

ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ টেস্ট বন্ধ করার জন্য নারী সংগঠনগুলি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছে৷ ভারতীয় সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ ধারা অনুসারে কন্যাভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ অবৈধ৷ এই আইন লঙ্ঘনে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার বা চিকিত্সাকর্মীর তিন বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা হতে পারে, যদি তাঁরা জন্মের আগেই ভ্রণের লিঙ্গ মা-বাবা বা আত্মীয় অভিভাবকদের আগেভাগেই জানিয়ে দেন৷ তবে গর্ভস্থ ভ্রুণ যদি জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে গর্ভপাত করা যেতে পারে এবং সেটা করতে হবে গর্ভের ১২ সপ্তাহের মধ্যে৷ এইসব সত্ত্বেও কিন্তু প্রাইভেট ক্লিনিকগুলিতে মুনাফার লোভে গোপনে দিব্যি চলছে কন্যাভ্রুণ হত্যার কাজ৷

কন্যাভ্রুণ হত্যার প্রধান কারণ আর্থিক, পারিবারিক ও সামাজিক৷ কোনো মহিলা যদি কন্যাভ্রুণ হত্যায় রাজি না হয়, তাহলে স্বামীর হাতে দৈহিক ও মানসিক লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়৷ এমনকি সেই কারণে স্ত্রীকে পরিত্যাগ পর্যন্ত করা হয়৷ রাজ্য তামিলনাড়ুতে এক সমীক্ষায় অর্ধেক মা স্বীকার করেছেন, স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির চাপে কন্যাভ্রুণ হত্যার জন্য তাঁকে গর্ভপাতে রাজি হতে হয়৷