চীনের পণ্য বর্জনের হিড়িক
২৮ অক্টোবর ২০১৬চলতি বছরের শুরু থেকেই ভারতের বাজারে চীনা পণ্য বয়কটের ডাক দিয়ে মেসেজ চালাচালি হচ্ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়৷ তখন পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমশ চড়ছে৷ একটি বার্তা বহুল প্রচারিত হলো, যে ভারতে ঢালাও বিক্রি হয় চীনা পণ্য৷ সেই মুনাফা থেকে ভারতের শত্রু পাকিস্তানকে অর্থ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে, নানাভাবে সাহায্য করে চীন৷ কাজেই সমস্ত চীনা পণ্য বয়কট করুন৷ তা হলে একইসঙ্গে চীন এবং পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়া যাবে৷
এই চীনবিরোধী ‘জিগির' শুধু সেখানেই থেমে রইল না৷ কারণ ততদিনে পরমাণু প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশগুলোর জোটের সদস্য হতে ভারতের উদ্যোগে বাগড়া দিতে শুরু করেছে চীন৷ সেখানেও চীনের বক্তব্য পুরোপুরি পাকিস্তানঘেঁষা৷ বেজিং বলেছিল, ভারত পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র প্রসার রোধ চুক্তিতে সই করেনি, তা সত্ত্বেও যদি ভারত ওই জোটের সদস্যপদ পায়, তাহলে পাকিস্তানকেও সদস্য করতে হবে৷ পাকিস্তানও ওই চুক্তিতে সই করেনি বলে তাদেরকে জোটের বাইরে রাখা হয়েছে৷
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেই সময় অনেক উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷ প্রথমে জোটের বাকি দেশগুলো সমর্থন দিয়ে চীনের আপত্তিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছিলেন, তারপর সরাসরি চীনের সঙ্গে সমঝোতা করারও চেষ্টা করেছিলেন৷ কিন্তু তারপরও সফল হননি৷ এর পরই ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং সরকারপন্থি যোগগুরু ও শিল্পোদ্যোগী বাবা রামদেব চীনা পণ্যের বিরুদ্ধে একটা জাতীয়তাবাদী ভাবনা জাগিয়ে তুলতে তৎপর হন৷ বিশেষ করে এই দীপাবলী উৎসবের আগে তারা বারবার চীনা পণ্য বয়কট করার সপক্ষে বিবৃতি দিতে থাকেন৷ তার কারণ, দীপাবলীতে ঘর সাজানোর বাহারি আলো থেকে আতসবাজি, উৎসবের মরশুমে ভারতে এক বড় টাকার ব্যবসা করে চীন৷ সেই পণ্যের বিক্রি যদি কিছু অংশও আটকে দেওয়া যায়, সেটাই ছিল উদ্দেশ্য৷ এর মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে, সীমান্তপার জঙ্গি হামলা এবং পাল্টা সামরিক আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, দেশে একটা যুদ্ধের জিগির উঠেছে৷ এবং হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ফেসবুকে চালু থেকেছে চীনা পণ্য বয়কটের আবেদন৷
ফলে আদতেই বেশ মার খেয়েছে চীনা আলো এবং আতসবাজির বিক্রি৷ অবশ্য সরাসরি চীনা সরবরাহকারীরা এই বয়কটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা কিন্তু নয়৷ বরং দেশজুড়ে যেসব স্থানীয় ব্যবসাদার প্রতি বছরের মতো এ বছরও উৎসবের আগে প্রচুর পরিমাণে চীনা পণ্য মজুত করেছিলেন, মার খেয়েছেন তাঁরা৷
খোলা বাজারে এইসব ঘরসজ্জার পণ্যের বিক্রি অন্তত ৬০% কমে গেছে৷ উত্তর বঙ্গ এবং উত্তর–পূর্ব ভারত, মূলত যে দুটি জায়গা দিয়ে চীনা পণ্য ভারতে ঢোকে, সেখানে রীতিমতো সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধ হয়েছে চীনা পণ্যের বিরুদ্ধে৷ রাতের অন্ধকারে, চুপিসারে যাতে চীনা পণ্য ঢুকতে না পারে, তার জন্য ব্যবসায়ীদের একাংশ এমনকি রাতপাহারাও দিয়েছেন৷ এর প্রভাব পড়েছে রোজকার বিক্রিবাটাতেও৷ দোকানিরা চীনা পণ্য রাখতে ভয় পেয়েছেন অশান্তির আশঙ্কায়৷ কাজেই কূটনৈতিক চাল হিসেবে চীনা পণ্য বয়কটের ডাক অংশত যে সফল, সেটা সবাই দেখতে পাচ্ছেন৷
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, চীন আদতেই কি কোনো ‘উচিত শিক্ষা' পেল? এই বয়কটে কতটা ক্ষতি হলো চীনের?
বৃহস্পতিবারই চীন প্রথম এ ব্যাপারে, সরকারিভাবে তাদের মতামত জানিয়েছে৷ না, চীন আদৌ ব্যাপারটাকে গুরুত্বহীন বলে দেখানোর চেষ্টা করেনি, বরং নিজের বিরক্তিই প্রকাশ করেছে৷ বলেছে, চীন গোটা বিশ্বের পয়লা নম্বর ব্যবসায়ী দেশ৷ ‘ট্রেডিং নেশন'৷ এবং তাদের সারা বছরের ব্যবসার মাত্র ২% রপ্তানি হয় ভারতে৷ কাজেই সেই ২% ব্যবসা কমে গেলে চীনের আদৌ কোনো ক্ষতি হবে কিনা, সেটা ভারত ভেবে দেখুক৷
কিন্তু ভারত বিকল্প ব্যবস্থা না করে যদি চীনা পণ্য বয়কট করে, তা হলে ভারতীয় ব্যবসাদারদেরই ক্ষতি৷ আদতে ঠিক সেটাই কিন্তু ঘটেছে৷ মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন সেই সব খুচরো ব্যবসায়ীরা, যাঁরা রাজনীতি, কূটনীতির এত মারপ্যাঁচ বোঝেন না৷ দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদের থেকেও যাঁদের কাছে বেশি জরুরি নিজের, পরিবারের, কর্মচারীদের পেট ভরানো৷ তাদের উৎসব যে এবার অনেকটাই নিরানন্দ হলো, তাতে কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই৷
একইসঙ্গে একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছে চীন৷ বলেছে, এই চীনা পণ্য বয়কটের ডাক ভবিষ্যতে চীনা লগ্নিকারদের দু'বার ভাবাবে ভারতে শিল্পে বিনিয়োগ করার আগে৷