ভারতে প্রস্তুতিহীন কোরবানি ঈদের আয়োজন
১৭ জুলাই ২০২০কোরবানি ঈদ বললেই ডাক্তারবাবুর কথা মনে পড়ে৷ ঈদ এবং তার পরের দিন রাতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে খাবার দেওয়াই ছিল তাঁর দস্তুর৷ ডাক্তারবাবু সারা বছর ধরে বহু গরিব মানুষের চিকিৎসা করেন নিখরচায়৷ আর তারই পুরস্কার মেলে কোরবানি ঈদের দিন৷ রোগীরা এসে মাংস, বিরিয়ানি দিয়ে যান৷ পরিমাণে তা এতই বেশি যে, ডাক্তারবাবু বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়েও শেষ করতে পারেন না৷ আর মনে পড়ে, বন্ধু আতাহারের মায়ের কথা৷ ছোটবেলায় ওই দিনটায় পাত পেড়ে খাওয়াতেন আমাদের সকলকে৷
সেই ডাক্তার এবং বন্ধু আতাহার-- দু'জনেই এবার বড় হতাশ৷ খানিক মন মরাও৷ উত্তর ২৪ পরগনার যে প্রত্যন্ত প্রান্তে ডাক্তারবাবু চিকিৎসা করতে যান, লকডাউন এবং আমফানের পর সেখানে ভয়াবহ পরিস্থিতি৷ লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ৷ আমফানে অনেকের বাড়ি ঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে৷ টাকার অভাবে তা সারিয়েও উঠতে পারেননি অনেকে, এখনও৷ তারই মধ্যে মুসলিম অধ্যুষিত ওই এলাকায় হাহাকার শুরু হয়েছে৷ কোরবানি ঈদে পশু কেনা হবে কীভাবে? টাকা পাওয়া যাবে কোথা থেকে? আর আতাহার বলছে, এত মানুষ এত কষ্টে, এত অবহেলায় আছে যে, এই ঈদে তাদের পাশে দাঁড়ানোটাই আসল কর্তব্য৷ উৎসব পরে হবে৷
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশের গ্রামগুলোর যা চেহারা, লকডাউনের পরে ভারতের দিকে দিকে নানা কোণে একই রকম পরিস্থিতি৷ মানুষের হাতে টাকা নেই৷ কোলের মেয়ের হাতে বিস্কুট ধরিয়ে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরেছেন যে পরিযায়ী শ্রমিকরা, প্রতিদিন হাঁড়িতে ভাত চড়ানোর অর্থটুকুও তাদের হাতে এখন নেই৷ তারই মধ্যে বাড়ছে করোনার প্রকোপ৷ লকডাউন কখনো উঠছে, কখনো আবার নতুন করে চালু হচ্ছে৷ এই পরিস্থিতিতে কোরবানি ঈদ দেশের মুসলিম জনগণকে ভাবাচ্ছে৷ কোরবানি জরুরি, কিন্তু সামর্থ্য নেই৷
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষার অধ্যাপক এবং ইসলামিক স্কলার মহম্মদ ইশরাত আলি মোল্লাও ঠিক এ কথাগুলিই বলছিলেন৷ আমফানের পর দক্ষিণবঙ্গের কী মর্মান্তিক পরিস্থিতি, তা তিনি নিজের চোখে দেখেছেন৷ তার মতে, ইসলাম ত্যাগের মহিমার কথা বলে৷ মানুষের উপকারের কথা বলে৷ লোভ বর্জনের কথা বলে৷ কোরবানিও আসলে একরকম ত্যাগ৷ ডয়চে ভেলেকে ইশরাত আলি মোল্লা বলেছেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে কোরবানির জন্য অর্থ খরচ কমিয়ে তা যদি গরিব মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে অনেক বড় কাজ হবে৷ এ কাজ করলে ধর্মের অবমাননা হয় না৷ ইসলাম সব সময়ই সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়েছে৷ গরিব মানুষকে সাহায্য করার কথা বলেছে৷'' এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণও টেনে এনেছেন ইশরাত সাহেব৷ তার দাবি, ২০১৩ সালে সিরিয়ায় মুসলিম উলেমা পরিষদ একটি ফতোয়া জারি করেছিল৷ কোরবানির জন্য অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে তা দান করতে হবে যুদ্ধবিধ্বস্ত সব হারানো গরিব মানুষদের৷
কোরবানি ঈদের দিন শুধু কলকাতা শহরেই দেড় থেকে দুই লাখ পশু জবাই হয়৷ একেকটি পশুর দাম কম করে ১০ হাজার টাকা৷ কোনো কোনো পশু বিক্রি হয় এক লাখ টাকারও বেশি দামে৷ তার জন্য ঈদের আগে থেকেই শহরের বিভিন্ন প্রান্তে পশুর হাট বসে৷ খিদিরপুর, জাকারিয়া স্ট্রিট, নারকেল ডাঙার পশুর হাট বিখ্যাত৷ নারকেল ডাঙার পশু হাট অবশ্য সারা বছরই চলে৷ তবে ঈদের আগে তা বিশেষ চেহারা পায়৷ বহু মানুষের সমাগম হয়৷ খিদিরপুরের হাটে উট, দুম্বা বিক্রি হয়৷ ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেখানে পশু আসে৷ গত সপ্তাহ থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে কলকাতায়৷ ফলে আপাতত সেভাবে হাট বসছে না৷ ঈদের আগে আদৌ তা বসবে কিনা, কেউ জানেন না৷ শহরের বাইরে থেকে আদৌ পশু আমদানি করা যাবে কিনা, গেলেও তা বিক্রি করা যাবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে৷ তাহলে কি প্রতিবারের মতো এবার কোরবানি ঈদ হবে না?
মাত্র কিছু দিন আগে ঈদ-উল-ফিতরের সময় লকডাউনের কারণে কলকাতার সমস্ত মসজিদ বন্ধ ছিল৷ নাখোদা মসজিদের ইমাম স্বয়ং সকলকে বাড়িতে থাকার আর্জি জানিয়েছিলেন৷ কোরবানি ঈদ নিয়ে তিনি কী বলছেন? ডয়চে ভেলেকে ইমাম শফিক কুরেশি কাসেমি জানিয়েছেন, ‘‘লকডাউনের কারণে পশুর হাট আগের মতো বসছে না৷ তবে হাতে যেহেতু এখনো বেশ খানিকটা সময় আছে, তাই এখনি কোনও সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি না৷ ইদ-উল-আজহা বা কোরবানি ঈদ মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ ফলে আমরা চেষ্টা করব যাতে এই উৎসব ঠিক মতো পালন করা যায়৷ তবে একই সঙ্গে করোনার কথাও মনে রাখতে হবে৷''
অল ইন্ডিয়া মুসলিম মজলিশ মুশায়েরাত হলো ভারতের সমস্ত মুসলিম সংগঠনের মূল মঞ্চ৷ সেই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নাভেদ হামিদ ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে তিন দিনে গোটা ভারতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়৷ শুধু পেশাদার পশু বিক্রেতারা নন, পশু হাটে বহু সাধারণ মানুষও পশু বিক্রি করতে আসেন৷ সারা বছর ধরে তারা কোরবানির জন্যই গবাদি পশু পালন করেন৷ কোরবানি ঈদের সময় তাদের এককালীন খানিকটা টাকা রোজগার হয়৷
ফলে অর্থনীতির কথা যারা বলছেন, তাদের ওই গরিব পশুপালকদের কথাও মাথায় রাখা উচিত৷ নাভেদের বক্তব্য, ‘‘কোরবানি ঈদ মুসলিমদের অবশ্য করণীয় উৎসব৷ কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলির উচিত ইসলামিক স্কলারদের সঙ্গে কথা বলে কীভাবে এই উৎসব এমন পরিস্থিতিতে করা সম্ভব, তা আলোচনা করা৷''
হামিদ সাহেবের কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার আখতারুল ওয়েসির বক্তব্যে৷ তার মতে, এর আগে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ফলে কোরবানি ঈদও পালন করতে দেওয়া উচিত৷ এটি মুসলিমদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব৷ ওয়েসি সাহেবের বক্তব্য, ‘‘করোনা সংকট এখনই কাটার নয়৷ কিন্তু তার মধ্যেই মানুষকে সব কিছু করে বেঁচে থাকতে হবে৷ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, সকলের উপকারের কথা মাথায় রেখে এই উৎসব কীভাবে করা যায়, তা ভাবতে হবে৷ আর কোরবানি তো একান্তই পারিবারিক বিষয়৷ প্রচুর লোকের জমায়েতে কোরবানি হয় না৷ সকলেই নিজস্ব পরিসরে তা করেন৷ ফলে করোনা পরিস্থিতিতে কোরবানি না হওয়ার কোনও কারণ নেই৷''
দিল্লির জামে মসজিদের শাহী ইমাম আহমেদ বুখারিও ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, কোরবানি ঈদ পালন করতেই হবে৷ কারণ এটি মুসলিমদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব৷ তবে সামাজিক দূরত্ব মেনে সকলকে উৎসবে সামিল হতে হবে৷ তার বক্তব্য, প্রতি বছরের মতো সকলে এক জায়গায় এসে নামাজ না পড়লেই ভালো৷ তার নির্দেশ, প্রত্যেক এলাকায় মসজিদ আছে৷ সকলে যেন নিজ নিজ এলাকার মসজিদে গিয়ে এ বছর ঈদের নামাজ পড়েন৷ বস্তুত, শাহী ইমামের বক্তব্য, নামাজ পড়ার আগে অজুও যেন সকলে বাড়ি থেকে করে আসেন৷ এক জায়গায় বসে সকলে মিলে অজু না করাই ভালো৷
ঈদ-উল-আজহার উৎসব নিয়ে সরকারের তরফ থেকে এখনো কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি৷ অনেকরই ধারণা, রথযাত্রা যে ভাবে ছোট করে করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কোরবানিঈদের ক্ষেত্রেও তেমনই কোনো নির্দেশ দিতে পারে সরকার৷ সাধারণ মুসলিমদের অনেকরই বক্তব্য, উৎসব হলেও কোরবানি প্রতি বছরের মতো এবার না-ও হতে পারে৷ কারণ, পশুর হাট প্রতি বছরের মতো এবার বসবে না বলেই তাদের ধারণা৷ ফলে সাধারণ হাট থেকেই অনেকে আগে থেকে পশু কিনে রাখছেন৷ অনেকে আবার দেশের বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন৷ তাদের বক্তব্য, গ্রামে করোনা নিয়ে এত নিয়মকানুন নেই৷ ফলে সেখানে কোরবানি দেওয়াও সহজ হবে৷ করোনা কালে গ্রামের মানুষের হাতে টাকা কমে গিয়েছে৷ কোরবানির পশু তাদের কিনতে সমস্যা হচ্ছে৷ শহরের লোক টাকা পাঠালে তাদের পশু কিনতেও অসুবিধা হবে না, আবার ধর্মও রক্ষা পাবে৷
উত্তর ২৪ পরগনার যে গ্রামের কথা বলে লেখা শুরু করেছিলাম, সেই গ্রামেও শহর থেকে অনেকে কোরবানির জন্য টাকা পাঠাচ্ছেন বলে খবর পেলাম৷