ভারতে বিরল দৃষ্টান্ত রাখলেন এক জার্মান নারী
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭গো-রক্ষার নামে ভারতে যে তান্ডব চালাচ্ছে তথাকথিত গো-রক্ষকরা, তা নিয়ে সমাজে কম জল ঘোলা হয়নি৷ গণপিটুনিতে মারা গেছে এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়৷ কিছুদিন আগে দিল্লি-মথুরা ট্রেনে গোমাংস নিয়ে যাচ্ছে বলে সন্দেহ করায় জুনেদ খান নামে এক কিশোরের প্রাণ যায় নকল গো-রক্ষকদের হাতে৷ প্রধানমন্ত্রী ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে এদেরকে বলেছেন নকল গো-রক্ষক৷ মহাত্মা গান্ধী বা আচার্য় বিনোবাভাবের আদর্শের বিপরীত৷ এরা সাম্প্রদায়িক সদ্ভাব নষ্ট করতে চাইছে৷ তাতে কি ? গো-রক্ষার নামে গৈরিক পতাকাটা তো উড়ানো যাবে৷
পাশাপাশি এর সঙ্গে তুলনা টেনে বলা যায় প্রকৃত গো-সেবা কাকে বলে তার দৃষ্টান্ত রেখেছেন এক জার্মান মহিলা৷ নাম ফ্রিডারিশ ইরিনা ব্রুনিং৷ ভারতীয় দর্শনের গুরুবাদে প্রাণিত হয়ে বার্লিন থেকে ভারতে এসেছিলেন তিনি ১৯৭৮ সালে ২০ বছর বয়সে৷ এখন তাঁর বয়স ৫৯ বছর৷ ভারতে এসে উনি যান উত্তরপ্রদেশের মথুরার রাধাকুন্ডে নতুন গুরুর খোঁজে৷ তাঁর উপলব্ধি, গুরুই শুধু পারেন জীবনে এগিয়ে যাবার পথ দেখাতে৷ নিজের মুখেই মথুরা যাত্রার কথা জানান ব্রুনিং৷
বলেন, সেখানে গিয়ে এক প্রতিবেশীর সনির্বন্ধ অনুরোধে একটি গরু কেনেন৷ তারপর থেকে তাঁর জীবনের পথটাই যায় পাল্টে৷ মনপ্রাণ সঁপে দেন গোসেবায়৷ তিনি দেখলেন গবাদি পশু বুড়ো হয়ে গেলে, দুধ দেবার ক্ষমতা না থাকলে তাকে রাস্তাঘাটে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ মালিকের খাটালে তার আর জায়গা হয় না৷ মালিকের কাছে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়৷ বাতিল হয়ে যায় এরা৷ রাস্তাঘাটে ঘুরতে ঘুরতে অনাহারে অর্ধাহারে অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা রাস্তায় গাড়ির ধাক্কায় আহত বা পঙ্গু হয়ে পড়ে কিংবা মরে যায়৷
কলিযুগে মানুষ স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বোঝে না৷ কিন্তু ব্রুনিং অত স্বার্থপর হতে পারেনি৷ গবাদি পশুর ক্লেশে তাঁর মন কেঁদে ওঠে৷ ব্রুনিং তখন তাদের তুলে নিজের তৈরি গোশালায় আশ্রয় দেন৷ খাদ্য, পানীয়, ওষুধপত্র, চিকিত্সা সবকিছুর ব্যবস্থা করেন পরম মমতায়, মাতৃস্নেহে৷ ব্রুনিংয়ের নিজের কথায়, ‘‘এরা আজ আমার কাছে সন্তানের মতো৷ অনেক সময় দেখেছি, অসুস্থ, আহত গরুকে আমার আশ্রমের কাছে কেউ ছেড়ে দিয়ে গেছে. তখন ওদের আমি ফেলতে পারি না৷ এখন লোকমুখে ব্রুনিংয়ের নাম সুদেবি মাতাজী৷ আর ৩৩০০ বর্গ গজ জমিতে গড়ে তোলা তাঁর গোশালার নাম সুরভি গোশালা নিকেতন৷
‘‘গরু বাছুর মিলিয়ে ১২০০-রও বেশি গরু-মহিষ আছে আমার গোশালায়. সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খোলা থাকে৷ নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্সও আছে৷ জরুরি ডাক পেলে ছুটে যায়৷ এখন এই গোশালায় দেখা দিয়েছে স্থানাভাব৷ জায়গা করার জন্য গোশালাকে আলাদা আলাদা ভাগ করা হয়েছে৷ যেসব গরুর বিশেষ সেবাযত্নের প্রয়োজন, তাদের জন্য পৃথক জায়গা'', বলেন জার্মান মহিলা ইরিনা ব্রুনিং.
এই বিরাট গোশালা চালানোর খরচ কেমন? কে জোগায় সেই খরচ? উত্তরে ইরিনা জানালেন, ‘‘পশু খাদ্য, ওষুধপত্রের খরচ আর গোশালার কর্মীদের বেতন ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে খরচ পড়ে মাসে ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা৷ আমার এখানে কাজ করেন ৬০ জন কর্মী৷ বার্লিনে আমার ঘরবাড়ি, বিষয় সম্পত্তি কিছু আছে৷ সেখান থেকে ভাড়াবাবদ টাকা পাই৷ শুরুর দিকে আমার বাবা টাকা জোগাতেন৷ তখন তিনি কাজ করতেন নতুন দিল্লির জার্মান দূতাবাসে৷ এখন আমার বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন৷ এখন তিনি জার্মানির প্রবীণ নাগরিক৷ তবে স্থানীয় সরকার থেকে কোনো অর্থ সাহায্য পাইনা৷ তা সত্বেও কোনো রকমে ম্যানেজ করে নিই৷ কারণ, এই গোশালা আমি কিছুতেই বন্ধ করতে পারবো না৷ এতগুলো লোক এখানে কাজ করে৷ এখানকার মাইনে দিয়ে তাঁদের পরিবারের ভরণপোষণ হয়৷ সেটাও একটা মানবিক দিক৷'' তবে ক্ষোভ নিয়ে তিনি জানালেন, এখনও পর্যন্ত ভারত সরকার তাঁকে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা মঞ্জুর করেনি৷ তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব নিতে পারেননি৷ নিলে বার্লিন থেকে তাঁর টাকা আসার পথ বন্ধ হয়ে যাবে৷ কৃষ্ণভূমিতে গো-সেবাতেই এখন তিনি নিবেদিত প্রাণ৷ হিন্দি ভাষাটাও তিনি রপ্ত করেছেন বেশ ভালো৷