ভোজ্যপণ্য
২৪ মার্চ ২০১২বিশ্বের সর্ববৃহৎ দুগ্ধ রপ্তানিকারক দেশ ভারতে সরকারি খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নতুন এই সমীক্ষায় দুগ্ধে দূষণের ব্যাপারে যে সংখ্যাটা বের হয়ে এসেছে, তা রীতিমত আতঙ্কজনক৷ বিভিন্ন রাজ্য থেকে দুধের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, তাতে পানি, চর্বি, গ্লুকোজ, মিল্ক পাউডার ইত্যাদির অস্তিত্ব রয়েছে৷ এমনকি কোনো কোনো নমুনায় সার, ইউরিয়া, সাবান ইত্যাদির চিহ্নও পাওয়া গেছে৷ এই সব বস্তু স্বাস্থ্যের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকারক, এমনকি ক্যানসারের মত কঠিন রোগেরও উদ্দীপক৷
সব ধরনের খাদ্যেই ভেজাল
খাদ্য কর্তৃপক্ষ সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে জানায় যে, শুধু দুগ্ধজাত দ্রব্যই নয়, তরিতরকারি, মাংস, ফলফলারির ১৩ শতাংশ ভেজালযুক্ত৷ ১২০ কোটি অধিবাসীর দেশ ভারতে অনেকেই এখন তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত৷
শোনা যাক এক ব্যক্তি কি বলছেন, ‘‘আমি মনে করি এর চেয়ে খারাপ আর কিছু নেই যে, আমরা জানি না আমরা কী খাচ্ছি৷ গণমাধ্যম থেকে আমরা জানতে পারছি যে, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল রয়েছে৷ মাঝে মাঝে ইন্সপেক্টরদের আচমকা আবির্ভাবের কথাও শোনা যায়৷ কিন্তু খাদ্যদ্রব্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ আমরা হারিয়ে ফেলেছি৷''
আরেক জন জানান, ‘‘একবার দুধ কিনতে গিয়ে দেখি, আমি সচরাচর যে কোম্পানির দুধ কিনে থাকি তা ফুরিয়ে গেছে৷ তাই অন্য ধরনের দুধ কিনতে হয় আমাকে৷ পরদিন আমার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে৷ এখন আমার মুরগির মাংসও খেতে ভয় হয়৷ কেননা তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠার জন্য এগুলিকে ইনজেকশন দেয়া হয়৷''
এক মহিলা বলেন, ‘‘কোথায় আমরা স্বাস্থ্যকর খাবার পাব? এই দুধ নিজে খেতে বা বাচ্চাদের দিতে স্বাভাবিকভাবেই আমার ভয় হয়৷ কিন্তু আমাদের উপায়টা কী? এ ক্ষেত্রে তো আমরা অসহায়৷''
ভারতে দুধ এক প্রধান খাদ্য৷ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে দুগ্ধজাত মিষ্টির প্রচুর ব্যবহার হয়৷ গরু একটি পূজনীয় প্রাণী হিন্দুদের কাছে৷ ভেজালযুক্ত দুগ্ধজাত দ্রব্য অতীতেও খবরের শিরোনাম হয়েছে৷ ২০০৮ সালে ভারতের পূর্বাঞ্চলে ৬ শিশুর মৃত্যু হয়৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্কুলে দেয়া ভেজাল দুধ খেয়ে এই বাচ্চাদের মৃত্যু হয়েছে৷
রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার
হাটবাজারে তরিতরকারি ব্যবসায়ীরা দ্বিধা না করেই আপেল উৎপাদনে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের কথা জানান৷ অনেক ফলফলারি কয়েকশ কিলোমিটার দূর থেকে কাঁচা অবস্থায় বাজারে বিক্রির জন্য আনা হয়৷ এরপর রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পাকানো হয় সেগুলিকে৷ দেয়া হয় রঙ, যাতে ফলগুলিকে চকচকে মনে হয়৷ নয়া দিল্লির সেন্টার ফর সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সাভি সৌম্য মিশ্র এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই দরিদ্র৷ তাদের পণ্য ভাল মূল্যে বিক্রি করতে চান তারা৷ লক্ষ্য রাখেন, দেখতেও যেন পছন্দসই হয় এসব৷ যেমনটি চান ক্রেতারা৷ ভারতের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কীটনাশক ও সারের তালিকা প্রস্তুত করেছে, যেগুলি একেবারেই খেতে ব্যবহার করা উচিত নয়৷ কিন্তু এই তালিকা চাষিদের কাছে পৌঁছায় না৷''
সামর্থ্যের অভাব
ভারত এক বিশাল দেশ, তাই সমস্যাও কম নয়৷ হতাশাব্যঞ্জক সুরে বলেন সাভি মিশ্র৷ সারা দেশের জন্য মাত্র দুই হাজার খাদ্য নিয়ন্ত্রক রয়েছেন৷ এই সংখ্যা কমপক্ষে ছয় হাজার হওয়া প্রয়োজন৷ কিন্তু বর্তমান বাজেটে এ বাবদে ৬ মিলিয়ন ডলার ধার্য করা হয়েছে৷ খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের মাত্রা আতঙ্কজনক রূপ নেওয়ায় ভারত সরকার এ বাবদ চার গুণ অর্থ বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ সাভি মিশ্র জানান, ‘‘এ ক্ষেত্রে আইন কানুন ও বিধিবিধান চালু রয়েছে ২০০৬ সাল থেকে৷ ২০০৮ সাল থেকে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ দপ্তর গঠন করা হয়৷ তবে এ সংক্রান্ত আইনের প্রক্রিয়াটি শেষ হতে হতে ২০১১ সাল লেগে যায়৷ এতে বোঝা যায়, একটা কাঠামো গড়ে তুলতে ও কার্যকর করতে কতটা সময় গড়াতে পারে৷ কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট অর্থ নেই, নিয়ন্ত্রক নেই৷ রয়েছে অল্প কয়েকটি গবেষণাগার৷ তার মানে সাফল্যের প্রথম আলো দেখতে হলে আরো বহু সময় লেগে যাবে৷
২০০৮ সালে চীনে দুধ নিয়ে এক কেলেঙ্কারি সংবাদের শিরোনাম হয়৷ মেলামাইন নামে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা দূষিত হয় দুধ৷ এই দুধ পান করে ৬ শিশু মারা যায়৷ ২০০৯ সালে এজন্য দায়ী দুই ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়৷ ভারতে খাদ্য দ্রব্যে ভেজালকারীরা হয় শাস্তি ছাড়া, নয়তো অল্প অর্থের জরিমানা দিয়েই পার পেয়ে যান৷ যা তাদের ঘাবড়ে দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়৷
প্রতিবেদন: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন