মুসলিম পারিবারিক আইন
২২ জুন ২০১৪গত প্রায় সাত বছর ধরে ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন সংক্ষেপে বিএমএমএ নামের একটি সংগঠন এই প্রথম মুসলিম সমাজে বিবাহ, ডিভোর্স এবং খোরপোষ সংক্রান্ত ইসলামিক আইন সংশোধন নিয়ে কাজ করার পর, মুসলিম মহিলা পারিবারিক নিয়ম-নীতির এক আচার-সংহিতা চূড়ান্ত করেছে৷ এই খসড়ার নাম দেয়া হয়েছে মুসলিম বিবাহ ও ডিভোর্স আইন৷ তাতে মুখে তিনবার তালাক বলে কোনো মুসলিম পুরুষ তাঁর স্ত্রীকে ডিভোর্স করতে পারবেন না৷
শুধু তাই নয়, মুসলিম পুরুষদের বহু বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ডিভোর্স হলে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে খোরপোষ দেয়া এবং নিকা বা বিবাহ করার সময় কন্যাকে বরের পক্ষ থেকে যে যৌতুক দেয়া হয় তার পরিমাণ নির্দিষ্ট করা থাকবে এই খসড়ায়৷ ডিভোর্সের ক্ষেত্রে একমাত্র ‘‘তালাক-ই-এহসান'' মানা হবে৷ এতে তালাক দেবার পর তিন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷ এছাড়া স্বামী-স্ত্রীকে দাম্পত্য কলহ মিটিয়ে নেবার একটা সুযোগ দেয়া হবে৷ ভুল বোঝাবুঝি দূর হলে উভয়পক্ষের সম্মতি সাপেক্ষে আবার তাঁদের পুনর্মিলনও হতে পারে৷ অর্থাৎ স্বামী তাঁর তালাক তুলে নিতে পারে৷ তবে বারংবার একই অপরাধ করলে অপরাধীর কড়া জরিমানা হবে এবং কাজির লাইসেন্স বাতিল করা হবে৷ আর খোরপোষের ক্ষেত্রে নিয়ম অমান্য করলে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যাবে৷ বুধবার, ১৮ই জুন, এই খসড়া চূড়ান্ত করে বিএমএমএ আশা প্রকাশ করেছে যে, সরকার ভারতীয় মুসলিম নারী সমাজের অবস্থার উন্নতিতে এই আচার-সংহিতা কার্যকর করবে৷
আচার-সংহিতার মধ্যে আছে নিকার সময় মুসলিম পাত্রীর বয়স হতে হবে কমপক্ষে ১৮ বছর এবং পাত্রের বয়স হতে হবে কমপক্ষে ২১ বছর৷ তাছাড়া নিকার সময় পাত্র-পাত্রীর জীবিত দ্বিতীয় কোনো স্বামী বা স্ত্রী থাকতে পারবেন না যাতে বহু বিবাহ বন্ধ করা যায়৷
বলা বাহুল্য, মুসলিম শরিয়ত নিয়মে কোনো মুসলিম পুরুষ চারবার বিবাহ করতে পারে৷ আর মেহের বা বিয়ের সময় পাত্রপক্ষ পাত্রীকে যে যৌতুক দেন, তার পরিমাণ পাত্রের মোট বার্ষিক রোজগারের কম হলে চলবে না৷ বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে মেহের বা যৌতুকের পরিমাণ মেটানো না হলে, পরে তার দ্বিগুণ দিতে হবে পাত্রকে৷ বর্তমানে কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেহের হিসাবে পাত্র ৭৮৬ টাকার কমও দিয়ে থাকে৷
ভারতীয় মুসলিম সমাজ ১৯৩৬ সালের ‘মুসলিম পার্সোনাল আইন' বা শরিয়াত দ্বারা পরিচালিত৷ কিন্তু শরিয়াত আইন বিধিবদ্ধ নয়৷ এটা স্থানীয় মৌলবিদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী প্রয়োগ করা হয়৷ ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের দাবি, মুসলিম পার্সোনাল আইন লিখিত ও বিধিবদ্ধে করতে হবে যাতে এর নিয়মকানুনগুলি সকলের বোধগম্য হয়৷
রক্ষণশীল মুসলিম সমাজ সেই দাবি কী মানবে? অবশ্যই না৷ তাঁদের মতে, সেটা করলে তা শরিয়াত আইনকে বিকৃত করা হবে যা মুসলিম জনসমাজের জীবনযাত্রার পরিপন্থি৷ সরকারও হয়ত মৌলবিদের চটাতে চাইবে না নানা কারণে৷ অথচ হিন্দুত্ববাদী বিজেপির নির্বাচনি ইস্তাহারে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে – একই দেশে দু'রকম আইন থাকতে পারে না এই যুক্তি দেখিয়ে৷ তাছাড়া অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর না হলে দেশে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা অসম্ভব৷ মুসলিম শরিয়াতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একবিংশ শতাব্দীতে শরিয়াত আইনের সংশোধন দরকার – এমনটাই মনে করে মোদী সরকার৷
উল্লেখ্য, ১৯৮৫ সালের শাহ বানু মামলার কথা৷ জনৈক মুসলিম আইনজীবী ৪০ বছর একসঙ্গে ঘর করার পর তাঁর ৭০ বছরের বদ্ধা স্ত্রী শাহ বানুকে তালাক দেন৷ শাহ বানু আদালতে খোরপোষের আবেদন জানালে আদালত তা মঞ্জুর করে৷ এরপর তাঁর স্বামী সুপ্রিম কোর্টে গেলে শীর্ষ আদালত তা বহাল রাখে সর্বভারতীয় ফৌজদারি বিধি অনুসারে৷ তৎকালীন রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস সরকারও তা সমর্থন করে৷ এই ইস্যু নিয়ে শুরু হয় রক্ষণশীল মুসলিমদের সঙ্গে সরকারের সংঘাত৷ গোড়া মুসলিম সমাজের মতে হিন্দু আইন সরকার জোর করে মুসলিমদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে৷ পরিনামে কংগ্রেস স্থানীয় নির্বাচনে হেরে যায়৷ পরবর্তীতে জনৈক সাংসদ মুসলিম পার্সোনাল সুরক্ষা বিল সংসদে আনলে কংগ্রেস তা সমর্থন করে৷ কাজেই মোদী সরকার এবার গোটা দেশে সব ধর্মাবলম্বীদের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি আইন বলবৎ করতে পারবে কিনা – তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সংশয় থেকেই যাচ্ছে৷