লেখাপড়ার কোনো বয়স হয় না
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭মা বা ঠাকুরমার মতো প্রবীণ মহিলাদের কীভাবে লেখাপড়া শেখান? এই উদ্যোগ হাতে নেবার শুরু থেকেই এই প্রশ্নটার মুখোমুখি হতে হয়েছে বছর তিরিশের শিক্ষিকা শীতল মোরেকে৷ গত বছর যখন তিনি চালু করেন এই স্কুল৷ আর সেই তখন থেকেই এই প্রশ্ন৷
গ্রামের নাম ফানগানে৷ ছবির মতো গ্রাম৷ মুম্বই থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে৷ বড় বড় গাছের ছায়ায় চটের আচ্ছাদনের নীচে মাটিতে পা মুড়ে বসে আছেন প্রবীণ মহিলারা শিক্ষিকার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে৷ পরনে সবারই একই রঙের শাড়ি, গোলাপি৷ এটাই ঠাকুমা-স্কুলের ইউনিফর্ম৷ বয়স সবারই পঞ্চাশের উপরে৷ কেউ কেউ আশির কোঠায়৷ বয়সের কারণে এঁদের সকলেরই স্মৃতিশক্তি দুর্বল৷ তাই একই কথা বলতে হয় বারংবার৷ কেউ কেউ আবার কানে কম শোনেন৷ তাই খুব জোরে জোরে বলতে হয়, পড়াতে হয়৷ ছাত্রীরা সবাই মারাঠি ভাষায় অক্ষর লিখতে পড়তে শিখছেন৷ সংখ্যা গুণতে শিখছেন৷ চোখের জোর কমে আসায় অক্ষরগুলিকে অতসী কাঁচের নীচে এনে পড়তে হয়৷ ক্লাসের আদব-কায়দার ধার ধারে না তাঁরা৷ মুখে বয়সের বলিরেখা৷ নাকে বড় বড় নোলক৷ শীতলের দৃষ্টি আকর্ষণে সবাই কথা বলতে চায় একসঙ্গে৷ শিক্ষিকা শীতলকে তাঁদের কথা বুঝতে এবং তাঁদের শান্ত করতে হিমসিম খেতে হয়৷ কেউ কেউ বাড়িতে বিয়ে আসছে, তাই নিয়ে হাসি মশকরা শুরু করে৷ অন্যরা হেসে ওঠে সমস্বরে৷
আর টিপসই নয়
ক্লাস হয় ঘণ্টা দুয়েক৷ এই দু'ঘণ্টা ঘর সংসারের কাজ থেকে মুক্তি৷ এরই মধ্যে অনেকটাই স্বাক্ষর হয়েছে ওঁরা৷ নিজের নাম সই করতে পারে৷ সংখ্যা গুণতে পারে৷ একটা আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদারভাব ফুটে উঠেছে চেখেমুখে৷ আগে আমি ব্যাংকের কাগজপত্রে টিপসই দিতাম৷ এখন নিজের নাম সই করি৷ দারুণ অনুভূতি৷ এবার ব্যাংকে গেলে ব্যাংকের অফিসাররা আমায় দেখে অবাক হয়ে যাবেন, বলেন বছর পঞ্চান্নের পড়ুয়া যশোদা কেদার৷ এরমত আরও অনেক মহিলা আছেন যাঁরা নিজের বয়স কত, জানে না৷ কারণ তাদের জন্মকলে বার্থ সার্টিফিকেটের চল ছিল না৷ এদের শৈশব কেটেছে চরম দারিদ্র্যে৷ যশোদার মনে পড়ে এমন কতদিন গেছে ঘরে মাঠে হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও পেটে একটা দানা পর্যন্ত পড়েনি৷ তার ওপর মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত একেবারে নাবালিকা বয়সে৷ লেখাপড়ার সুযোগই ছিল না৷
চ্যালেঞ্জ আরও আছে সামনে
মোতিলাল দালাল দাতব্য ট্রাস্টের অধীনে এই ঠাকুরমা-স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা দিলীপ দালাল মনে করেন, ভারতে বয়স্ক নিরক্ষরতার হার বিশবে সর্বাধিক৷ প্রায় ২৯ কোটির মতো৷ জাতিসংঘের রিপোর্ট এবং পরিসংখ্যানও বলছে সে কথা৷ যদিও সরকার নিরক্ষরতা দূরিকরণে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছে৷ শিক্ষাকে করেছে মৌলিক অধিকার৷ তবে সমস্যা হলো নারী সাক্ষরতার অভাব এবং স্কুলশিক্ষার সুযোগ সুবিধার অপ্রতুলতা৷ গ্রামে মেয়েদের স্কুল না থাকার মতো৷ ফানগানে গ্রামের পাঁচ'শ অধিবাসী চাষাবাদের ওপর নির্ভরশীল৷ চাষ করে ধান, দানাশস্য শাক-শবজি ইত্যাদি৷ নির্মাণকাজে মেয়েদের কর্মসংস্থান হাতে গোনা৷ মেয়েদের কাজ ঘরসংসার করা, মাঠে কাজ করা এবং বাচ্চা সামলানো৷ আর পুরুষ সদস্যরা কাজের ধান্দায় ছোটে শহরের দিকে৷ কেউ কেই মুম্বইয়ে৷
শিক্ষালাভের সুযোগ-সুবিধায় বৈষম্য
সীমার খুড়তোতো ভাই সন্তোষ কেদার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পুনে শহরে যায়৷ কয়েক বছর থাকতে হয় ফানগানের বাড়ির বাইরে বিভিন্ন শহরে৷ পরিবারের যা আয় তা অনেকটাই বেরিয়ে যায় তাঁর কলেজের মাইনে দিতে৷ তাঁদের গ্রামে একটিমাত্র স্কুল৷ চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত৷ তারপর পড়তে গেলে যেতে হবে ১২ কিলোমিটার দূরে কাছের শহরে৷ গ্রামে বাস আসে না৷ ভাড়া করা জিপে সাত সকালে বেরিয়ে পড়তে হয় বাস ধরতে৷ ফলে গ্রামের মেয়েদের লেখাপড়ায় এখানেই ইতি৷ বাড়ির অভিভাবকরা মেয়েদের ছাড়তে ভয় পায় নিরাপত্তার কারণে৷ মেয়ে বলে কথা বলেন যশোদা৷
আমার নিজের মেয়ে সীমা চৌধুরি৷ বয়স ২৮ বছর৷ ক্লাস ফোর পর্যন্ত পডার পর মা কাকিমাদের গেরস্থালি কাজে হাত লাগায়৷ তারপর আর কী? বিয়ে৷ সীমার আক্ষেপ ছেলেদের মতো মেয়েরা সমান সুযোগ-সুবিধা পায় না কেন? কেন তাঁদের মেধা প্রতিভা বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত? কেন নাবালিকা বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন অভিভাবকরা? এ জন্য অবশ্য দায়ী পরিবারের রক্ষণশীলতা এবং সামাজিক রীতিনীতি৷ ছলছল চোখে সীমা বলন, বিয়ের পর কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ায় স্বামী তাঁকে তাড়িয়ে দেয়৷ তাঁর চাই পুত্রসন্তান৷ মেয়েকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়৷ ভয়ে পালিয়ে চলে আসি বাপের বাড়িতে এই ফানগানে গ্রামে৷ মেয়ে গায়ত্রীকে মানুষ করে তালাই আমার ধ্যানজ্ঞান৷ সে এখন পড়ছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে৷ আমি পড়াশুনার সুযোগ পাইনি, তাই মেয়েকে অনেক দূর পর্যন্ত পড়াতে চাই যাতে নিজোয়ে দাঁড়াতে পারে৷ গ্রের স্কুলের গণ্ডি পার হলে সে চলে যাবে পুনে শহরে বোনের বাড়িতে৷ সেখানে ভালো ভালো স্কুল আছে, কলেজ আছে৷
অগাধ আত্মবিশ্বাস
গত বছর মার্চে ফানগানে গ্রামে ঠাকুরমা-স্কুল খোলার পর নারী সাক্ষরতা অভিযানে একটা সচেতনা জেগে উঠেছে৷ যশোদার স্বামী প্রভাকরও খুশি এই অভিযানে৷ কারণ জীবনের বেলাশেষে যশোদা স্বাক্ষর হয়ে উঠেছে৷ ঠাকুরমা-স্কুল আমাদের গ্রামে নারী শিক্ষার মশাল বাহক৷ জ্বালিয়েছে প্রগতির আলো, আত্মসম্মানের আলো৷ যশোদা এখন ব্যাংকের কাগজপত্র, ক্যুরিয়ারে আসা চিঠিপত্র নিজেই সই করে নিতে পারেন৷ বলা বাহুল্য, এ সবই ঠাকুরমা-স্কুলের অবদান৷ নাতনি গায়ত্রী ঠাকুমাকে লেখাপড়ায় সাহায্য করে৷ স্লেটের লেখা সংশোধন করে দেয়৷ খুশিতে ঝলমল যশোদার মুখ৷ বলেন, ‘‘কখনও ভাবিনি স্কুলে যাব৷ লিখতে পড়তে পারব৷ নাতনি আমার হোমওয়ার্কে সাহায্য করবে৷ এ যেন আকাশের চাঁদ পাওয়া৷''