ভারতে শিক্ষাঙ্গনে বিদ্বেষের বিষ?
২১ নভেম্বর ২০১৯ভারতের ইতিহাসে দলিত পরিবারে জন্ম হওয়ায় অপরিসীম সামাজিক নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন ভীমরাও আম্বেদকর৷ পরে তিনিই ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতের সংবিধান প্রণয়ন করেছেন৷ সাত দশক আগে সামাজিক বিদ্বেষহীন দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি, যা সফল হয়নি এখনো৷
শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চিত্র
গত তিন-চার বছরে শুধুমাত্র দেশের শিক্ষাক্ষেত্রের দিকে তাকালে চোখে পড়বে কয়েকটি ঘটনা৷ অকালে ঝরে যাওয়া তাজা প্রাণগুলোর ‘অপরাধ' তারা অনগ্রসর ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে চেয়েছিলেন৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের বিদ্বেষ, শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতিত্ব হয় কেড়ে নিয়েছে, নচেৎ নিখোঁজ করেছে মেধাবী রোহিত ভেমুলা, নাজিব আহমেদ, পায়েল তাদবি, ফতিমা লতিফদের৷
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাত্র শুভদীপ মন্ডল ডয়চে ভেলেকে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘‘আমি নিজে একজন দলিত ছাত্র হওয়ায় শিক্ষাক্ষেত্রে সহপাঠী থেকে অধ্যাপক, সর্বস্তরে কুকথা শুনতে হয়েছে৷ আমার যোগ্যতা বিচার করা হয়েছে আমার জাতের নিরিখে৷ রোহিত ভেমুলা থেকে আজকের ফতিমাদের আত্মহত্যার ঘটনা চোখে আঙুল দেখিয়ে দিয়েছে উচ্চশিক্ষা নিতে এসে তাঁরা কতটা নির্যাতিত হয়েছেন৷ বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান নীতি নিয়ে এগোচ্ছে৷ অখণ্ড ভারতের তত্ত্ব গিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ তাদের মণুবাদ বলছে, ব্রাহ্মণরা ঈশ্বরের মাথা থেকে জন্মগ্রহণ করেছে আর দলিতরা নাকি ঈশ্বরের পা থেকে৷ ফলে, বোঝাই যায় এমন ভাবনার শিকড়টা কোথায়৷’’
মাদ্রাজ ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-র প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফতিমা লতিফ আত্মহত্যা করেছেন৷ ৮ নভেম্বর নিজের হস্টেলের রুমে গলায় ফাঁস লাগিয়ে, সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে পড়েছেন ফতিমা৷ অভিযোগের তির আইআইটির কয়েকজন শিক্ষকের দিকে৷ সুইসাইড নোটে তেমনই লিখে গেছেন ফতিমা৷ তদন্ত চলছে৷
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাত্র রোহিত ভেমুলা আত্মহনন করেছিলেন ২০১৬ সালে৷ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ বা এবিভিপি-র এক ছাত্রনেতা ফেসবুকে আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন৷ তার জেরে আম্বেদকর ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্রের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি হয়৷
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাঁচজন দলিত ছাত্রকে বহিষ্কার করে৷ সেই সঙ্গে হস্টেলসহ তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢোকা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়৷ সে বছর ১৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সাজাপ্রাপ্ত দলিত রোহিত ভেমুলা হস্টেলে গলায় দড়ি দেন৷
একইভাবে গত ২২ মে জাতিবিদ্বেষের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন মুম্বাইয়ের বিওয়াইএল নায়ার হাসপাতালের রেসিডেন্ট চিকিৎসক পায়েল তাদবি৷ তিনিও দলিত৷ তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ৷ পায়েলের মা আবেদা ও স্বামী সলমনের অভিযোগ, দলিত হওয়ায় মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হতো পায়েলকে৷
কোথায় নাজিব?
ডয়চে ভেলেকে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরান বলেছেন, ‘‘ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ছাত্রছাত্রীরা জাতিগত বিদ্বেষের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হওয়ার ঘটনাগুলো দুঃখজনক৷ এই ধরনের ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া অত্যন্ত জরুরি বিষয়৷ পুরো বিষয়টি একটি ধারণা থেকে জন্মায়৷ এই ধরনের ঘটনা রুখতে অবিলম্বে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত৷ দলিত ও সংখ্যালঘুদের প্রতি সমাজের মানসিকতা বদলাতে হলে বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তর থেকে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে৷’’
তিন বছর আগে নিখোঁজ হয়েছেন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজির ছাত্র নাজিব আহমেদ৷ জেএনিউ-এর ‘মাহি মান্ডভি হস্টেল’ থেকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি তাকে৷ ১৪ অক্টোবর রাতে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ সমর্থকদের হাতে প্রহৃত হয়েছিলেন তিনি৷ বেদম মারে অসুস্থ হয়েছিলেন৷ ১৫ তারিখ সকাল থেকে তিনি নিখোঁজ৷ নাজিবের মা ফতেমা আহমেদ আজও আশা করে বসে আছেন, তাঁর ছেলে ঠিক ফিরে আসবে৷ দিল্লি হাইকোর্টে ‘হেবিয়াস কর্পাস' আবেদন জানানো হয়৷ হাইকোর্ট পুলিশের তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে৷ পরে নাজিবের তথ্য দিতে পারলে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষিত হয়৷ আরো পরে পুরস্কার মূল্য দশ লক্ষ করা হয়৷ পরের বছর নাজিব নিখোঁজ মামলার তদন্তের ভার সিবিআইকে দেওয়া হয়৷ অবশেষে আদালতকে সিবিআই জানায়, নাজিব নিখোঁজ হওয়ার কারণ হিসাবে কোনো অপরাধের চিহ্ন মেলেনি, অতএব, মামলা বন্ধ করা হোক৷ তা-ই হয়েছে৷ মামলার তদন্ত আর হচ্ছে না৷