স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে থিয়েটার
৩১ মার্চ ২০১৪দিনটা ছিল মঙ্গলবার৷ সপ্তাহের দ্বিতীয় কাজের দিন৷ এবং সেটাও সকাল সাড়ে দশটা৷ যাকে বলে ব্যস্ত অফিস টাইম৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রসদন-আকাদেমি অফ ফাইন আটর্স চত্বর লোকারণ্য৷ সবাই এসেছেন নাটক দেখতে! চমকে দেওয়ার মতই ব্যাপার বটে৷ এই শোনা যায় বাংলা থিয়েটারের দর্শক কমছে, গ্রুপ থিয়েটার আর আগের মতো আন্দোলিত করে না মানুষকে – এসব কথা কি তা হলে ঠিক নয়!
তার আগে দেখা যাক, কারা এসেছিলেন ওই সাতসকালে নাটক দেখতে৷ অনুষ্ঠান শুরুর আগে তিন উদ্যোক্তা, নাট্যকর্মী সুমন মুখোপাধ্যায়, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কৌশিক সেন প্রথমেই জানালেন যে, তাঁরা কেউ আশাই করেননি যে নাট্যপ্রেমী মানুষজন এভাবে সাড়া দেবেন, এভাবে কাজের দিনে সব কাজ ফেলে নাটক দেখতে আসবেন! এদিনের প্রথম নাটক ছিল সকাল সাড়ে দশটায়, সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মেফিস্টো'৷ তার পর দুপুর দেড়টায় ছিল বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ক্যালিগুলা', বিকেলে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস চত্বরেই কবীর সুমনের গান, যার জন্য কোনও প্রবেশমূল্য ছিল না এবং সন্ধে সাতটায় কৌশিক সেন পরিচালিত ‘কর্কটক্রান্তির দেশে'৷
সুমন মুখোপাধ্যায় জানালেন, চার দিন আগেই তিনটি নাটকের সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে৷ হাউসফুল! শুধু কলকাতা থেকে নয়, লোকে এসেছেন মালদা থেকে, উত্তর দিনাজপুর থেকে, আরও দূর দূর থেকে এবং এঁদের অনেকেই সারা দিন ধরে আকাদেমি চত্বরে থাকবেন, নাটক দেখবেন৷ সুমন, বিপ্লব কৌশিক সমস্বরে বললেন, এতে ওঁরা নিজেরাও খুবই উৎসাহিত বোধ করছেন যে এখনও ভালো নাটকের দর্শকের অভাব নেই৷ তবু ওরা কুণ্ঠিত যে এভাবে কাজের দিন, তা-ও নেহাতই অসময়ে সবাইকে ডাকতে হল৷
কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, বাধ্যতাটা কী ছিল? সেটাও সুমন জানালেন যে পশ্চিমবঙ্গের এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নাটকের জন্য হল পাওয়া ক্রমশই অসুবিধাজনক হয়ে যাচ্ছে৷ ২২শে মার্চ আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ বিরোধী দিবস৷ সেই দিনটি উদযাপন করতে ওঁরা ঠিক করেছিলেন মেফিস্টো এবং ক্যালিগুলা নাটকদুটি মঞ্চস্থ করবেন৷ কিন্তু কিছুতেই হল পাচ্ছিলেন না৷ এদিকে কৌশিক সেন তাঁর দল স্বপ্নসন্ধানী-র নতুন নাটক কর্কটক্রান্তির দেশে মঞ্চস্থ করবেন বলে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের প্রেক্ষাগৃহটি ২৪ তারিখের জন্য আগে থেকে বুক করে রেখেছিলেন৷ যেহেতু ওঁরা দেখলেন, তিনটি নাটকই বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে খুব কাছাকাছি, সমবেত সিদ্ধান্ত হল, একই দিনে তিনটি নাটক অভিনয় করার৷ প্রসঙ্গত সুমন মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য ছিল, কেন যে হল পাওয়া যায় না, কী কারণে, সেটা তাঁদের অজানা!
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, পূর্বতন বাম জমানাতেও সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রেক্ষাগৃহগুলির বুকিং পাওয়ার ক্ষেত্রে, সরকারি অনুগ্রহের বৃত্তের বাইরে থাকা নাটকের দলগুলির কিন্তু একইরকম অসুবিধে হতো৷ সে সময়ও, সপ্তাহান্তে বুকিং পাওয়া ছিল কার্যত অসম্ভব এবং তারও কারণ ছিল অজানা! অথবা বব ডিলানের বিখ্যাত গান ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড-এর কবীর সুমন কৃত বাংলা ভাবানুবাদ থেকে উদ্ধৃত করে বলা যায়, প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা৷ বস্তুত সুমন মুখোপাধ্যায়রা তাঁদের এক দিনের এই নাট্যোৎসবের শিরোনামেই উত্তরটা দিয়ে রেখেছেন৷ রাষ্ট্রের কোনও ছবি নেই৷ ওঁরা সম্ভবত বলতে চেয়েছেন, রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট কোনও চেহারা হয় না৷ যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তারাই রাষ্ট্রশক্তি নামক ভয়ানক বর্মটি গায়ে চড়িয়ে নেয়৷ তখন আর তাদের আলাদা করে আর চেনার উপায় থাকে না৷ বরং ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে৷
তাই যখন মেফিস্টো নাটকে দেখা যায়, জার্মানিতে হিটলারের ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থিয়েটার দলগুলোতে কীভাবে বিরুদ্ধমতের লোকজনকে, এমনকি মত নিরপেক্ষ লোকজনকেও সরিয়ে দিয়ে স্তাবকদের বসানো হচ্ছে, নির্ভুলভাবে সবার মনে পড়ে যায়, একই স্বৈরাচারী ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে এই পশ্চিমবঙ্গেই৷ তখন রাজনৈতিক দলমতের ঊর্ধ্বে নাটক এবং এই উদযাপনের বিষয়বস্তুটা বড় হয়ে ওঠে৷ বোধোদয় ঘটায়, রাষ্ট্রের আদতেই কোনও মুখ হয় না৷ কারণ, মুখোশ, সে তো একটাই৷ সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র!