টি-টোয়েন্টি স্কোয়াড নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের খবরটা পড়ে মনে হলো, ‘‘এ আর নতুন কী! কী এমন নতুন কথা বলেছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন?''
বিরাট কোহলি, কেএল রাহুল এবং শ্রেয়স আইয়ারদের মতো ব্যাটসম্যানের অনুপস্থিতিতে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের গুরু দায়িত্ব সরফরাজের কাঁধেও খানিকটা তুলে দেয়া এবং প্রথম ইনিংসেই মুম্বাইয়ের ডানহাতি ব্যাটারের জাত চিনিয়ে দেয়া দেখে মনে হলো, ‘‘বাংলাদেশে এমন দেখি না কেন?''
দেখি না বলতে, কিছুই আসলে দেখি না৷ কী খেলোয়াড় তৈরি, কী তাদের পৃষ্ঠপোষকতা, গ্রুমিং, ধাপে ধাপে ছোট থেকে বড় পরিসরে সুযোগ দিয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে সফল হবার মতো করে গড়ে তোলা, কী নির্বাচন পদ্ধতি – সব কিছুতেই তো বাংলাদেশ প্রায় বিপরীত মেরুতে!
ঘরোয়া ক্রিকেট চলছে সেই গাড়ি চলে কিন্তু চলে না কায়দায়৷ টেস্ট ক্রিকেটের উপযোগী খেলোয়াড় তৈরির চেষ্টা বিসিবি মনে হয় কয়েক যুগের জন্য স্থগিত রেখেই বসে আছে৷
ওয়ানডের উপযোগী খেলোয়াড় তুলে আনার আদর্শ পরিকল্পনাও যে আছে, বলা যাবে না একেবারেই৷ হ্যাঁ, যা আছে, তা শুধু টি-টোয়েন্টির উপযোগী বোলার, ব্যাটার তৈরির যৎসামান্য চেষ্টা৷ সেটাও সিংহভাগ বিপিএল-কেন্দ্রিক৷ সেই বিপিএলও চলছে জোড়াতালি দিয়ে, হাজারো অসঙ্গতি নিয়ে এবং অনেক দৃষ্টিকটু ব্যর্থতাকে আড়াল করে৷
সেই বিপিএল-এর পারফরম্যান্সকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিয়েই গড়া হয় টি-টোয়েন্টি স্কোয়াড৷ মঙ্গলবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ ও প্রথম দুই ওয়ানডের জন্য দল ঘোষণা করা হলো।
তিন সংস্করণেরই অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পাওয়া নাজমুল হোসেন শান্তর অধীনে ১৫ সদস্যের দুটি স্কোয়াডে আছে বেশ কিছু পরিবর্তন। প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি দলে ডাক পেয়েছেন আলিস আল ইসলাম। চলমান বিপিএলে পারফরম্যান্স দিয়ে নজর কাড়ার কারণেই দেশের হয়ে খেলার সুযোগ পেতে চলেছেন ২৭ বছর বয়সি মিস্ট্রি স্পিনার৷
কিন্তু তাকে নিয়ে তেমন একটা আলোচনা নেই৷ গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের সবশেষ ওয়ানডে সিরিজে ডাক পাওয়া আফিফ হোসেন, হাসান মাহমুদ ও রাকিবুল হাসানের বাদ পড়া এবং তাদের জায়গায় মাহমুদউল্লাহ, তাসকিন আহমেদ ও তাইজুল ইসলামের সুযোগ পাওয়া নিয়েও বিশেষ আলোচনা নেই৷
সবশেষ টি-টোয়েন্টি সিরিজের রনি তালুকদার, মেহেদী হাসান মিরাজ, শামিম হোসেন পাটোয়ারি, তানভির ইসলাম, হাসান ও আফিফের জায়গায় নাঈম শেখ, আনামুল হক বিজয়, মাহমুদউল্লাহ, আলিস, তাসকিন ও তাইজুলের ডাক পাওয়ার ভালো-মন্দ নিয়েও নেই তেমন কোনো বিশ্লেষণ৷
তবে টি-টোয়েন্টি স্কোয়াডে পাঁচ ওপেনার রাখার বিষয়টি স্বাভাবিক কারণেই আবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে৷এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য সবারই জানা৷ সব পজিশনে নতুন নতুন ব্যাটার উঠে আসে না তো কী করা যাবে? ওপেনার তো নতুন বল খেলে, টিকে গেলে পুরোনো বলও খেলতে পারে- তো তাদেরই দুই, তিন, চার, এমনকি বেশি ঠেকে গেলে পাঁচজনকেই রেখে দাও স্কোয়াডে, যখন যাকে যেই পজিশনে খেলানো দরকার মনে হবে, খেলিয়ে দেয়া যাবে৷
অদ্ভুতুড়ে এই নিয়মে তো আগেও স্কোয়াড গড়েছেন নির্বাচকেরা৷ আবার ওয়ানডে বিশ্বকাপের সর্বশেষ আসরে পর্যাপ্ত ওপেনার না রাখার অপরিণামদর্শিতায়ও আমাদের খানিকটা অভ্যস্ত করে রেখেছেন তারা৷ বাংলাদেশের ক্রিকেটে এ-ই তো স্বাভাবিক, এতে অবাক হওয়ার কী আছে?
তবে বিপিএল-এ ‘যথেষ্ট' ভালো করলেও স্কোয়াডে না রাখার বিলাসিতা বাংলাদেশের নির্বাচকেরা এতদিন খুব একটা দেখাতে পারেননি৷ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের জাকের আলীকে না রেখে এবার যেন সেই ‘অপূর্ণতাও' মেটালেন৷
অবশ্য পঁচিশোর্ধ জাকের আলী অনীক যে চলতি বিপিএলে খুব আহামরি কিছু করেছেন তা-ও নয়৷
১৯ জানুয়ারি দুর্দান্ত ঢাকার বিপক্ষে হেরে যাওয়া ম্যাচে একেবারে শেষে ব্যাট করতে নামলেও কোনো বল মোকাবেলা করেননি৷ ২৩ জানুয়ারি ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে করেছিলেন ২০ বলে অপরাজিত ২৩, ২৬ জানুয়ারি সিলেট স্ট্রাইকার্সের বিপক্ষে ২৭ বলে ২৯, ৩০ জানুয়ারি রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে ৮ রানে হেরে যাওয়া ম্যাচে ৪ বলে করেছিলেন অপরাজিত ১৮ রান৷ তবে শেষ ওভারের প্রথম দুই বলে তাওহিদ হৃদয় (২৮ বলে ৩৯) এবং আমের জামালকে বিদায় করে ম্যাচ আসলে এক অর্থে শেষই করে দিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান৷ নো বল বা ওয়াইড না হলে শেষ চার বলে জাকের চার ছক্কা মারলেও জিততে পারতো না কুমিল্লা৷ সেই অবস্থায় ৬,৬,২ এবং ৪- এভাবে শেষ চার বলে ১৮ রান নিয়ে পরাজয়ের ব্যবধানই শুধু কমিয়েছিলেন জাকের আর দেখিয়েছিলেন হাতে তার ভালো স্ট্রোক আছে৷
২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের বিপক্ষে কুমিল্লার মাত্র ৭২ রান তাড়া করে ৭ উইকেটে জেতা ম্যাচে জাকের ব্যাটই করেননি৷ ৭ ফেব্রুয়ারি আগে ব্যাট করে ৭ উইকেটে ১৪৯ তোলে কুমিল্লা৷ ৮ বলে জাকের ১৮ রান না করলে চট্টগ্রামের বিপক্ষে ৩৪ রানের জয় পেতে নিশ্চয়ই কষ্ট হতো৷
৯ ফেব্রুয়ারি দুর্দান্ত ঢাকার বিপক্ষে চার উইকেটে জেতে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স৷ ১০ বলে ৬ রান করে সেই মাচে বরং দলকে হারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিলেন জাকের৷ ভাগ্যিস তাওহিদ হৃদয় ৫৭ বলে অপরাজিত ১০৮ রানের একটা ইনিংস খেলেছিলেন!
১৩ ফেব্রুয়ারি লিটন দাশ (৩১ বলে ৬০) আর মঈন আলীর (২৪ বলে অপরাজিত ৫৩) ঝড়ো ফিফটি এবং উইল জ্যাকসের হার না মানা সেঞ্চুরির (১০৮*) সুবাদে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সকে ৭৩ রানে হারায় কুমিল্লা৷ জাকের সেদিন ব্যাট করার সুযোগ পাননি৷
জাকের আলী মোটামুটি বলার মতো একটা ইনিংস খেলেছেন ১৪ ফেব্রুয়ারি৷ সেই ম্যাচে খুলনা টাইগার্সকে ২১ বল বাকি থাকতে ৭ উইকেটে হারিয়েছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স৷ তাওহিদ হৃদয়ের অপরাজিত ৯১ আর জাকের আলীর ৩১ বলে হার না মানা ৪০ নিঃসন্দেহে বিপিএলের সফলতম ফ্র্যাঞ্চাইজির সেদিনের জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে৷
কিন্তু সব মিলিয়ে বিপিএল-এর এই কয় ম্যাচে তরুণ ব্যাটার-উইকেটকিপার জাকেরের পারফর্ম্যান্স কতটা ভালো?
২০ বলে অপরাজিত ২৩ + ২৭ বলে ২৯ + ৪ বলে ১৮ + ৮ বলে ১৮ + ১০ বলে ৬ + ৩১ বলে ৪০ অপরাজিত = ১০০ বলে ১৩৪ রান!
হ্যাঁ, ছয় ম্যাচে ১০০ বলে ১৩৪ রান করা জাকেরকে স্কোয়াডে না রাখাতেই তীব্র উষ্মা প্রকাশ করেছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। তার মনে হয়েছে, এ খুবই অবিচার, হয়তো ‘চেহারা'র কারণেই জাকেরকে বিবেচনায় নেয়নি বিসিবি।
এমন উষ্মা প্রকাশ খুব অযৌক্তিক নয়৷ স্কোয়াডে পাঁচজন ওপেনার না রেখে মিডল অর্ডারের বিকল্প হিসেবে রাখাই যেতো জাকেরকে৷ কিন্তু রাখলে হয়ত একটু ব্যর্থ হলে বাদও পড়ে যেতেন৷ সেরকম দৃষ্টান্ত তো কম নেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে৷ তার চেয়ে ভালো মনে হয় সরফরাজ খানের মতো দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি সেরে আত্মবিশ্বাসী হয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে পা রাখা৷
জীবনের প্রথম টেস্ট ইনিংসে জেমস অ্যান্ডারসন, মার্ক উড, টম হার্টলি, রেহান আহমেদদের মুখোমুখি হওয়ার আগে ৪৫টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে একটি ট্রিপল সেঞ্চুরিসহ ১৪টি সেঞ্চুরি, ১১টি ফিফটি মিলিয়ে ৬৯.৮৫ গড়ে ৩,৯১২ রান করে এসেছেন সরফরাজ৷ সেই অভিজ্ঞতার পাটাতনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে রানআউট হওয়ার আগে ৬৬ বলে খেলেছেন ৬২ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস৷
সকালে সন্তানের অর্জিত টেস্ট ক্যাপে চুমু খেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন নওশাদ খান৷ দিন শেষে তার মুখে ছিল এক চিলতে হাসি৷ নওশাদ খান এখন আরেকটি আনন্দময় মুহূর্তের অপেক্ষায়৷ কয়েকদিন আগেই অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপ মাতিয়েছেন তার ছোট ছেলে মুশীর খান৷ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারত হেরে গেলেও ব্যাটে-বলে আলো ছড়িয়ে আসরের সেরা একাদশে জায়গা করে নিয়েছেন অলরাউন্ডার মুশীর৷
দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার মর্যাদায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ক্রিকেটকে একটা সংস্কৃতির উচ্চতায়ও নিয়ে যাওয়া ভারতে নওশাদ খানের জন্য দুই ছেলেকে একসঙ্গে দেশের হয়ে খেলতে দেখা এখন আর খুব দূরের স্বপ্ন নয়৷
সব ফর্ম্যাটকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিয়ে ক্রিকেটকে কার্যত সংস্কৃতির মর্যাদায় নিতে না পারলে পঞ্চপাণ্ডব-পর্ব শেষেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে দেখা দেবে বিশাল শুন্যতা৷ সব পরাজয়, সব ব্যর্থতার পর অজুহাতে সান্ত্বনা খোঁজা এবং প্রতিবার স্কোয়াড ঘোষণার পর সাময়িক আহাজারিতেও হয়ত ডুবে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেট৷
নওশাদ খানের এক ছেলে অনূর্ধ-১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ মাতিয়েছেন৷ আরেক ছেলে রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, কেএল রাহুল, শুভমন গিল, যশশ্বী জয়সোয়ালের মতো ব্যাটারদের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার ক্ষমতা দেখিয়েছেন প্রথম সুযোগেই৷ নওশাদ খানের পরিবারকে দেখেই তো অনেক কিছু শিখতে পারে বিসিবি৷
শিখতে চাইলে তো!