1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভুয়া খবর সমাজের পাশ বালিশ

১৪ আগস্ট ২০২০

পাঁচ ফোড়ন ছাড়া যেমন ডাল হয় না, ভুয়া খবর ছাড়া তেমন সংবাদ হয় না। যতই আমরা সমালোচনা করি না কেন!

https://p.dw.com/p/3gxFB
Indien Narendra Modi TV-Ansprache
ছবি: picture-alliance/AP/C. Anand

সদ্য কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছি। স্নাতকোত্তর পড়তে পড়তেই চাকরির সুযোগ পাওয়া গেল একটি নতুন খবরের কাগজে। সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়। আনন্দবাজার পত্রিকা ছেড়ে নিজের কাগজ তৈরি করেছেন। শিক্ষানবিশ সাংবাদিককে দিনকয়েকের মধ্যে অমোঘ নির্দেশ দিয়েছিলেন সম্পাদক মহাশয়। তিনটি বিষয় নিয়ে যেন কখনও জ্বালাতন না করা হয়। এক, দাউদ ইব্রাহিম, দুই, ফিদেল কাস্ত্রোকে অ্যামেরিকার মারার চক্রান্ত এবং তিন, তাজমহল এক সময় মন্দির ছিল।

কী বলছেন? গোটা স্কুল জীবনে দাউদ ইব্রাহিমের স্টোরি খবরের কাগজে থাকলেই তো গোগ্রাসে গিলতাম! হ্যাঁ, একদম গোগ্রাসে। ততদিনে গাদাখানেক সিনেমাও দেখা হয়ে গিয়েছে। দাউদ মানেই গাল পর্যন্ত কালো চশমা, উপরের ঠোঁট ঢাকা ঝাঁটা গোফ। এক হাতে সিগারেট আর অন্য হাতে ফোনের রিসিভার। এই গোটা বর্ণনার মধ্যে খটকা কেবল একটাই ছিল, প্রায় অন্ধকার ঘরেও ভদ্রলোক কেন গগলস পরে থাকেন। তবে এসব প্রশ্ন মনেই থেকেছে। দাউদকে নিয়ে কৌতুহল এতটুকু কমেনি। বরং বেড়েছে প্রায় প্রতি বছর কোনও না কোনও কাগজে অন্তত খান কয়েক দাউদ সংক্রান্ত স্টোরি পড়ে। কিছুদিন পর যার দায়িত্ব নিয়ে নেয় টেলিভিশন।

কার্যত এক দশকের স্কুল জীবনে দাউদের স্টোরির অবশ্য বিশেষ বদল ঘটেনি। অধিকাংশই ছিল, কীভাবে প্রায় বাগে পেয়েও শেষ পর্যন্ত ধরা যায়নি তাকে। কীভাবে সাংবাদিক বহু কাণ্ড করে দাউদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পাকিস্তানে তার প্রাসাদের প্রতিটি ঘরের বর্ণনা। অথবা দাউদ ঘোরতর অসুস্থ। এতটাই যে, এটাই সম্ভবত তাকে নিয়ে শেষ লেখা।

১৪ বছর সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকে এখন বুঝতে পারি, কেন শিক্ষানবিশ সাংবাদিককে সম্পাদক দাউদ ছুঁতে নিষেধ করেছিলেন। এক সময় যা গিলতাম, তার গোটাটাই কার্যত ভুয়া। সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমগুলো জানে এ খবর ভালো 'খায়'। তাই টিআরপি কম থাকলেই বানিয়ে ফেলো দাউদকে নিয়ে একটা খবর। এ খবরের সুবিধা হলো কোনও রিজয়েন্ডার নেই। চ্যালেঞ্জ করতে হলে প্রমাণ করতে হবে যে চ্যালেঞ্জকর্তা দাউদকে চেনেন। ভারতে তেমন বুকের পাটা কার-ই বা আছে! সুতরাং যা খুশি লিখলেও কোনও সমস্যা নেই।

এক সময় অ্যামেরিকাও ঠিক এভাবেই কমিউনিস্ট শাসক ফিদেল কাস্ত্রোকে নিয়ে প্রোপাগান্ডা ছড়াতো বলে শোনা যায়। কতরকমভাবে ফিদেলকে মারার ছক হয়েছে। কী কী চেষ্টা হয়েছে। কী ভাবে তাঁর চুরুটে বিষ মেশানো হয়েছে, এখনও গড়গড় করে বলে যেতে পারি। তৎকালীন কমিউনিস্ট পশ্চিমবঙ্গে এসব খবরহটকেকের মতো মুখে মুখে ঘুরতো। সংবাদপত্রের দফতরে ঢুকে বুঝতে পারলাম, কীভাবে এসবখবর 'ম্যানুফ্যাকচার' হয়।

তাজমহল নিয়ে অবশ্য সম্পাদকের সঙ্গে একমত ছিলাম না। কলেজে পড়াকালীন হিন্দুত্ববাদী কোনও কোনও গোষ্ঠী জোর গুজব ছড়াতে শুরু করে যে, তাজমহল আসলে ত্যেজ মন্দির। মন্দিরের জায়গায় সৌধ তৈরি করেছিলেন শাহজাহান। বিষয়টি যে সম্পূর্ণ মিথ্যা তা বোঝার জন্য ইতিহাসের ছাত্র হওয়ারও প্রয়োজন হয় না।

শিক্ষানবিশের বক্তব্য ছিল, এই মিথ্যাকথাগুলোর বিরুদ্ধে যথেষ্ট সরব হওয়া উচিত এবং এদের মুখ বন্ধ করা উচিত। পোড়খাওয়া সম্পাদকের জবাব ছিল, নেগেটিভ পাবলিসিটি গুজব ছড়াতে আরও সাহায্য করে। ফলে একজন বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকের ওই পথেই পা বাড়ানো উচিত নয়। গুজবকে প্রশ্রয় দেওয়ার সময় এবং মানসিকতা-- দুটোই কোনও সাংবাদিকের থাকা উচিত নয়। যদিও দেশের একাধিক সংবাদমাধ্যম দিনের পর দিন ওই স্টোরি চালিয়ে টিআরপি গুণে গিয়েছে।

যত দিন গিয়েছে, সৎ এবং বস্তুনিষ্ঠ শব্দ দুটির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি লড়াই করতে হয়েছে। সব সময় ছেলেবেলার শিক্ষা পেশাদার হিসেবে পালন করতে পেরেছি কিনা, হলফ করে বলতে পারি না। পেশার সঙ্গে যেহেতু বেতন জড়িয়ে, এমন অনেক কাজ করতে হয়েছে, যা স্বেচ্ছায় করতে চাইতাম না। সহকর্মীদেরও বহু সময় এমন কথা বলতে শুনেছি, এখনও শুনি। তবে দাউদ জাতীয় খবর এড়িয়ে চলার শিক্ষাটুকু এখনও পালন করার চেষ্টা করি।

মুশকিল হলো, এড়াতে চাইলেই কি এড়ানো যায়? তখন কাজ করি কলকাতার একটি বিখ্যাত টেলিভিশন চ্যানেলে। প্রতিদিন সকালে রিপোর্টারদের একটা করে স্টোরি আইডিয়া দিতে হয়। ক্রাইম বিটের সহকর্মী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু দিনের পর দিন বকুনি খায় মিটিংয়ে। বিটের খবর মিস না হলেও নতুন স্টোরি দিয়ে উঠতে পারে না রোজ। কনফারেন্স কলে দিল্লি কর্তৃপক্ষ আর কনফারেন্স রুমে কলকাতা কর্তৃপক্ষ কার্যত তুলোধোনা করেন রোজ। কেন কোনও খবর নেই? একদিন কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে আমার সেই অতি কাছের বন্ধু মুখ চোখ বেঁকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ''একটা ব্লাস্টও তো হতে পারে কলকাতায়। নিশ্চিন্তে দুটো দিন ঘুমোই!'' বলাই বাহুল্য সত্যি সত্যি ব্লাস্ট হলে গোটা শহরের ঘুম চলে যেতো। কিন্তু ক্রাইম রিপোর্টারের ঝুলিতে কিছু খবর জমতো। গালাগাল থেকে কয়েকটা দিন রেহাই মিলতো। বলতে দ্বিধা নেই, এর কিছুদিনের মধ্যেই বিশেষ সূত্রকে উদ্ধৃত করে 'যে কোনও সময় ব্লাস্ট হতে পারে কলকাতায়' শীর্ষক একটি খবর করেছিল সে। রিজয়েন্ডার আসেনি। কারণ, খবরে কলকাতা পুলিশের যথেষ্ট প্রশংসা ছিল।

মনে পড়ছে আরও এক বন্ধুর কথা। জাতীয় গণমাধ্যমের নাম করা সাংবাদিক। মালদার ভাঙন নিয়ে একটা প্রোফাইল স্টোরি করতে চায়। দীর্ঘ কথা হলো। মালদার কিছু ব্যক্তিকে যোগাযোগের নম্বরও দেওয়া গেল। কয়েক দিনের মধ্যেই ফিচার পাতায় ব্যানার স্টোরি। অসাধারণ লেখা। ছবির মতো। সাধুবাদ জানাতে ফোন করলাম। দু'চার কথায় স্পষ্ট হলো, বন্ধুবর মালদায় যাননি। যোগাযোগ করেছিলেন একজনের সঙ্গে। কথা হয়েছে মিনিট দশেক। বাকি কথা অধমের সঙ্গে। তাতেই স্টোরি দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কথা শেষে একটা ডিসক্লেইমার ছিল। জীবনে ভুলবো না। ''বিভূতিভূষণ যদি লাইব্রেরিতে বসে চাঁদের পাহাড় লিখে ফেলতে পারেন, তাহলে আমার আর দোষ কী?''

রিপোর্টারদের এই এক জ্বালা। প্রতিদিন এক্সক্লুসিভ খবর থাকে না পকেটে। অথচ প্রতিযোগিতা সাংঘাতিক। গাদাখানেক নিউজ চ্যানেল, ডজনখানেক কাগজ। এখন আবার বিষ ফোঁড়া পোর্টাল। কে কখন কোথায় একটা এক্সক্লুসিভ নামিয়ে দিল-- সম্পাদক মহাশয়ের মুখের মানচিত্র বদলে গেল। আর সম্পাদকের কথা বন্ধ মানে রিপোর্টারের মাথায় ঘুরছে ইনক্রিমেন্ট, বোনাস, অ্যাপ্রাইসাল। চাকরি গেলে খাবে কী? অগত্যা কিছু একটা করে দেখাতে হবে। টেলিভিশনের দুনিয়ায় তখনই করে দেখানো যায়, যখন খবর বেশ সেনসেশন তৈরি করতে পারে। খুনের আসামি খুন করার আগে লাল চা নাকি দুধ চা খেয়েছিলেন, সেটাই লোকে খায়। সব চেয়ে ভালো হয়, যদি পারিবারিক কেচ্ছা সামনে নিয়ে আসা যায়। কার বউ কার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কোথায় পালিয়ে ছিল, তারপর বয়ফ্রেন্ডকেও ধোঁকা দিয়ে কীভাবে সে বাড়িওয়ালার প্রেমে ডুবে গেল। এবং শেষ পর্যন্ত খুন হলো প্রথম বরের তৃতীয় প্রেমিকার স্বামীর হাতে। যে কিনা খুনের আগে প্রেমিকার প্রিয় লাল চা খেয়েছিল। এই গল্পটাই পাবলিক খায়। আর পাবলিক যা খায়, চ্যানেল সেটাই চায়। চ্যানেল যেটা চায়, রিপোর্টারকে সেটাই দিতে হয়। এটা এক প্রকার চক্র। খবর বিক্রির চক্র। এই কথাটি স্পষ্ট করে মাথায় গেঁথে না নিলে মূলস্রোতে ভেসে থাকা মুশকিল। কমবেশি সকলকেই এ কথা শুনতে হয়েছে কোনও না কোনও বসের মুখে।

তবে এটাই সব নয়। স্রোতের উল্টো দিকেও থাকেন অনেকে। কমপ্রোমাইজ করেও কীভাবে মূলগত এথিক্সটুকু বাঁচিয়ে রাখা যায়, এমন শিক্ষাও তো পেয়েছি এই ১৪ বছরের জীবনেই। এক সময় আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার শিখিয়েছিলেন, সোর্সের কাছ থেকে পাওয়া খবরের ২০ শতাংশ ছাপতে হয়, বাকিটা নিজের কাছে রেখে দিতে হয়। রাজনৈতিক সম্পাদক দেবাশিস ভট্টাচার্য শিখিয়েছিলেন, জমিয়ে রাখা সেই কথাগুলোই একেবারে ভিন্ন পরিসরে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। সোর্স বাঁচিয়ে রাখতে হয় কীভাবে।

Syamantak Ghosh
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

রিপোর্টারের জীবনে সোর্সই প্রধান চালিকা শক্তি। সোর্স বেঁচে থাকা মানে খবর বেঁচে থাকা। সমস্যা হলো, সোর্সকে সময় দিতে হয়। পৌঁছে যেতে হয় তাঁর রান্নাঘর পর্যন্ত। তৈরি করতে হয় বিশ্বাসযোগ্যতা। বুলেট ট্রেনের বিশ্বে সব রিপোর্টারের ভাগ্যে সে সময় জোটে না। ইনস্ট্যান্ট কফির মতো ইনস্ট্যান্ট সেনসেশন চাই। মিঠুন চক্রবর্তীর সংলাপ ছিল-- 'মারবো এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে'। খবর হতে হবে এমনই। কলকাতায় মুখ খুললে কানপুরে অনুরণন হবে। ফলে কোনো কোনো রিপোর্টার সহজ রাস্তাটা বেছে নিয়েছেন। এমন খবর করতে হবে, যাতে রিজয়েন্ডার নেই, কিন্তু সেনসেশন আছে। হোক না তা মনগড়া। চাকরি তো বেঁচে গেল! ফাউ হিসাবে জুটল জনপ্রিয়তা।

পাঠক খেয়াল করবেন, যখনই কোনও রাঘব বোয়াল প্রশাসনের জালে ধরা পড়ে, তার মূল অপরাধ ছাড়িয়ে আনুষাঙ্গিক বিষয় আলোকবৃত্তে চলে আসে। আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন সারদা মামলার আসামী সুদীপ্ত সেন আর দেবযানী। পাঠক, আপনারাই কিন্তু সে সময় গোগ্রাসে গিলেছিলেন দেবযানীর বিউটি পার্লারের বিলের খবর। আপনারাই কিন্তু উত্তেজিত ছিলেন সুদীপ্ত-দেবযানীর সম্পর্ক নিয়ে। আপনারাই কিন্তু দুপুরে রকের আড্ডায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন দেবযানী বিয়ে করেননি? সে কি সুদীপ্তের জন্য? চোলি কা পিছে কেয়া হ্যায়?

কেচ্ছা সেনসেশন সমাজের পাশ বালিশ। ঘুমনোর জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু পাশ বালিশ ছাড়া ঘুম, কল্পনাও করা যায় না। যত দিন সমাজের এই খিদে থাকবে, ততদিন মিডিয়ার তা বেচার স্বার্থ থাকবে। আর ঠিক ততদিনই একের পর এক মনগড়া কাহিনি রচনা করে যাবেন সেই সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সাংবাদিককূল। তা সে যতই অন্যায় এবং অনৈতিক হোক।