ভেনিস
২৯ অক্টোবর ২০১৫‘ভাপোরেতো' মানে হচ্ছে জলজ স্কুটার ট্যাক্সি৷ সেই ভাপোরেতো করে কিংবা গন্ডোলায় চড়ে স্বপ্নের শহর ভেনিসে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ানো যায়৷ রিয়ালটো ব্রিজ সহ ভেনিসের ক্যানাল বা খালগুলোর উপর মোট চারশো সেতু বা সাঁকো আছে৷
স্থপতি সিলভিয়া রাফায়েলা ইটালির মানুষ৷ ভেনিসে তাঁর পেশার মানুষজনের অনেক কাজ আছে বলে তাঁর ধারণা৷ তিনি বলেন, ‘‘একবার দেখুন, কি চমৎকার! নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যেন সৌন্দর্যের অভ্যন্তরে, ইতিহাসের অভ্যন্তরে বাস করছি৷ ভেনিসের স্থাপত্যের অর্থ বাকি জগতের চেয়ে কিছুটা আলাদা – কারণ আমাদের প্রধান কাজ হল এই স্থাপত্যকে বাঁচিয়ে রাখা, এর রূপান্তর ঘটানো৷''
পুরো শহরটাই যেন কোনো শিল্পীর ‘মাস্টারপিস'৷ ১১৮টি দ্বীপ জুড়ে এই ‘শিল্পকর্ম' ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কোর তরফ থেকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়৷
ভেনিস তার মৌলিকতা বজায় রেখেছে৷ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিল্পী ও স্থপতিরা ক্যানালের ধারে অপরূপ প্রাসাদগুলি গড়ে তুলেছেন৷ শিল্পকলা বিশেষজ্ঞ ক্লাউডিয়া গ্র্যুনব্যার্গ বলেন, ‘‘একমাত্র অনন্য বা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ শহরেরই উত্তরাধিকারের খেতাব পাবার অধিকার আছে৷ বহু দ্বীপ আর উপহ্রদ মিলিয়ে ভেনিস এতোই অসাধারণ যে, বিশ্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের তালিকায় তার স্থান পাওয়াটা স্বাভাবিক৷ বলতে কি, ভেনিস ছাড়া ঐ তালিকা অসম্পূর্ণ থেকে যেতো৷'
বিপন্ন ঐশ্বর্য
কিন্তু ভেনিস আজ বিপন্ন৷ সাগরের জল এসে যখন ভেনিস ভাসিয়ে দেয়, এমনকি সান মার্কো চত্বরেও জল ওঠে, তখন সেই জলকে ভেনিসের মানুষরা বলেন ‘আকোয়া আল্টা'৷ ভেনিসের প্রাসাদগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে খাড়া করে পোঁতা গাছের গুঁড়ির ওপর; তবুও তারা প্রতিবছর কিছুটা করে ডুবে যাচ্ছে৷
ভেনিস যাতে একদিন পুরোপুরি সাগরের জলে হারিয়ে না যায়, সেজন্য ‘মোসে' নামধারী একটি প্রকল্প সৃষ্টি করা হয়েছে৷ পানির উচ্চতা এক দশমিক এক মিটার অতিক্রম করলেই বানের পানির বিরুদ্ধে চলমান বাঁধগুলি খুলে যাবে৷ এই সুবিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পটি ইউনেস্কোর অর্থানুকুল্যে বাস্তবায়িত হয়েছে৷ নিউ ভেনিস কনসর্টিয়াম মহাপরিচালক হের্মেস রেডি বলেন, ‘‘আমরা জানি পানি কতোদূর উঠবে৷ সেই অনুযায়ী আমরা পাল্লাগুলো খুলে দেব, যাতে সাগর থেকে উপহ্রদে জল ঢুকতে না পারে৷''
আরেকটি বিপদ হল পর্যটকদের ভিড়৷ বছরে দু'কোটির বেশি টুরিস্ট ভেনিসে আসেন৷ কাজেই বহু ভেনিসবাসী শহরের কেন্দ্র থেকে বিদায় নিচ্ছেন, যা ভেনিসের সত্তা ও মৌলিকতার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে৷ ভেনিস শেষমেষ একটা মিউজিয়াম হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ ক্লাউডিয়া গ্র্যুনব্যার্গ বলেন, ‘‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার পরিষদ ভেনিসকে তার কর্তব্য স্থির করে দিতে না পারলেও তাদের একটা প্রতীকী গুরুত্ব রয়েছে৷ তারা কর্তৃপক্ষকে সক্রিয় হতে, টুরিস্টদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে বলতে পারে, যাতে টুরিস্ট এবং ক্রুজ জাহাজের সর্বোচ্চ সংখ্যা স্থির করা যায়৷ নগর কর্তৃপক্ষ তা না করলে পরিষদ ভেনিসকে তথাকথিত লাল তালিকায় রাখার সিদ্ধান্ত নিতে পারে – এটি হল বিপন্ন বিশ্ব উত্তরাধিকারসমূহের তালিকা৷ লাল তালিকায় ফেলাটা একটা বড় আকারের প্রতীকী পদক্ষেপ৷''
ভেনিসকে বাঁচাতে হলে
তা এড়ানোর জন্য একটা বিশেষ পর্যটন নীতি নিয়োগ করতে হবে৷ টুরিস্টদের ভিড় শহরের কেন্দ্র থেকে উপকণ্ঠে সরিয়ে দিতে হবে৷ শিল্পকলার মাধ্যমে অন্যান্য আকর্ষণ সৃষ্টি করতে হবে৷ এই ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান নিয়ে কাজ করছেন সরকারি কর্মকর্তারা এবং বেসরকারি, একক ব্যক্তিরা৷ ক্লাউডিয়া গ্র্যুনব্যার্গ-এর ভাষ্যে, ‘‘পর্যটন বিভাগ সংশ্লিষ্ট, প্রশাসন সংশ্লিষ্ট, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট৷ বিভিন্ন বড় বড় প্রাসাদের মালিকরাও সংশ্লিষ্ট৷ সবাই মিলে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছেন, কীভাবে এই শহরটাকে প্রধানত তার বাসিন্দাদের জন্য ধরে রাখা যায়, বেঁচে থাকার উপযোগী করে রাখা যায়৷ বিনিয়োগের অর্থ আসবে বিজ্ঞাপন থেকে – আর পর্যটন থেকে৷''
বিশ্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হওয়ার কারণে ভেনিসকে তার ঐতিহাসিক সম্পদ রক্ষা করতে হবে৷ কেননা এই ‘ভাসমান' শহরের সৌন্দর্য আর মৌলিকতাকে বাঁচাতে গেলে সকলকেই সক্রিয় হতে হবে – শুধু পর্যটকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই৷