ভোট-সহিংসতা, সিবিআই তদন্ত এবং বিতর্ক
৭ সেপ্টেম্বর ২০২১পশ্চিমবঙ্গে ভোট পরবর্তী সহিংসতা নিয়ে একটি রিপোর্ট দিয়েছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। তারপর বিজেপি কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে। সেই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। সিবিআই তদন্তও শুরু করে দিয়েছে।
সেই তদন্ত শুরু হতেই আরম্ভ হয়েছে বিতর্ক। বিশেষ করে রাজনৈতিক স্তরে। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের বন্যা বইছে। সিবিআইয়ের তদন্ত শেষ হয়নি। তারা দুইটি ক্ষেত্রে চার্জশিট দিয়েছে মাত্র। তা সত্ত্বেও বিতর্ক থামার নাম নেই। বরং তা জোরদার হচ্ছে।
কীভাবে তদন্ত করছে সিবিআই
সিবিআই এই তদন্তকে প্রভূত গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা চারটি বিশেষ তদন্তকারী ইউনিটে মোট ৮৪ জন কর্মীকে এই তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে। তারা রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছেন। প্রতিটি অভিযোগের তদন্ত করছেন। কিছু ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারও করেছে সিবিআই। যেমন বাঁকুড়ায় ভোটের পর তৃণমূল ও বিজেপি কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছিল। সেই ঘটনার সূত্রে সোমবার দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে সিবিআই।
দিনহাটায় হারাধন রায় নামে এক বিজেপি কর্মীকে খুন করার অভিযোগ ছিল। সেখানে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের পর একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। সোমবার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গত রোববার সিবিআই দল মুর্শিদাবাদ ও কোচবিহারে গেছে। মুর্শিদাবাদে এক নাবালিকাকে ভোটের পর সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছিল। পুলিশ ধর্ষণকারীদের গ্রেপ্তার করেছে। সিবিআই সেখানে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। শনিবার সিবিআই দল বাঁকুড়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় গিয়েছিল। তারা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছে। যে পরিবারের সদস্য খুন হয়েছে বলে অভিযোগ, তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। কিছু ক্ষেত্রে ঘটনার পুনর্নিমাণ করেছে।
বীরভূমে একটি খুনের ক্ষেত্রে সিবিআই অভিযুক্তের ফরেনসিক সাইকোলজিক্যাল পরীক্ষা করার জন্য আদালতের অনুমতি চেয়েছে। এটা একটা বিশেষ ধরনের পরীক্ষা, যার ফলে অভিযুক্ত সত্য কথা বলবে বলে দাবি করা হয়েছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুন হওয়া পরিবারের সদস্যরা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা পুলিশের সামনে সিবিআইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চায়নি।
সিবিআই তদন্ত নিয়ে বিতর্ক
সিবিআই যেভাবে তদন্ত করছে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। তৃণমূল এই তদন্ত নিয়ে একগুচ্ছ অভিযোগ করেছে। জবাব দিয়েছে বিজেপি। আর সিপিএমের অভিযোগ, তারা যখন বিশ্বভারতীতে অনিয়মের অভিযোগ করে মিছিল করেছিল, তখন তৃণমূলের গুণ্ডারা তাদের পিটিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, তৃণমূল ও বিজেপি হাতে হাত মিলিয়ে চলেছে।
তৃণমূলের অভিযোগ
তৃণমূলের মুখপাত্র ও রাজ্যসভার চিফ হুইপ সুখেন্দু শেখর রায় ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''ভোট পরবর্তী সহিংসতার তদন্ত কেন বলা হচ্ছে? বলা উচিত, ভোটের সময় সহিংসতা। ভোটের আগে যখন প্রশাসনের ভার নির্বাচন কমিশনের হাতে, তখন সহিংসতা হয়েছে। তৃণমূলের কর্মীরা অত্যাচারিত হয়েছেন। ভোটের পর সামান্য ঘটনা ঘটেছে। তবে একটাও ঘটনা ঘটা উচিত নয়। সহিংসতা হলে, তার তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেয়া উচিত।''
কিন্তু সুখেন্দুর অভিযোগ, ''সেই জায়গায় সিবিআই ব্যর্থ হয়েছে। তারা শুধু বিজেপি-র অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করছে। তৃণমূলের কর্মীরা যে খুন হয়েছেন, তাদের মামলার তদন্ত করা হচ্ছে না। আর বিজেপি-র অভিযোগের ক্ষেত্রে পুরো তদন্তটা হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে।''
সুখেন্দুর অভিযোগ, ''মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে তদন্ত হয়েছে। আর মানবাধিকার কমিশনে বিজেপি-র কর্মীরা এখন সদস্য। তার বক্তব্য, কোনো খুন হলে অপরাধ হলে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। তবে তার তদন্ত একটি দলের দিকে টেনে কেন করা হবে?''
বিজেপি-র পাল্টা অভিযোগ
তৃণমূলের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে বিজেপি। দলের রাজ্য নেতা সৌরভ শিকদার বলেছেন, ''পশ্চিমবঙ্গে প্রতিটি বিজেপি কর্মীকে পুলিশ দশটা করে মামলা দিয়ে রেখেছে। বিরোধী দলনেতা ও রাজ্য সভাপতি সহ। তাদের প্রায় প্রতি সপ্তাহে পুলিশের কাছে হাজিরা দিতে হয়। আমরা তো সেখানে যাই। আইনি পথে মোকাবিলা করছি। তৃণমূলের কিছু ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকলে তারা আইনি পথে এগোক। হাইকোর্ট আছে। সুপ্রিম কোর্ট আছে। সেখানে গিয়ে বলুক।''
সৌরভের বক্তব্য, ''মানবাধিকার কমিশনে তো তৃণমূলও যেতে পারত। এখনো যেতে পারে। তাদের অভিযোগ নিয়ে। তৃণমূল তো হাইকোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। বিচারপতিদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।''
সৌরভের মতে, ''আগে সিবিআই-কে তদন্ত শেষ করতে দেয়া হোক। তারপরও তো আপত্তি করার সময় থাকবে। বিজেপি চায় দোষীরা শাস্তি পাক।''
আইনি পথে কেন অভিযোগ নয়
প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তার প্রশ্ন, ''তৃণমূল কেন মৌখিকভাবে এই অভিযোগ করছে, কেন তারা আইনি পথ নিচ্ছে না। তারা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ করুক। বলুক, তদন্তের কাজ ঠিকভাবে হচ্ছে না। তারা অন্তত তদন্ত শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করুক।''
খাঁচাবন্দি তোতা
সিবিআই-কে নিয়ে এর আগে আদালতও কটাক্ষ করেছে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সিবিআই হলো খাঁচাবন্দি তোতা। সম্প্রতি মাদ্রাজ হাইকোর্ট বলেছে, সিবিআইকে খাঁচাবন্দি তোতার দশা থেকে মুক্ত করতে হবে। তারা একটা নির্দেশনামাও দিয়েছে, যাতে সিবিআইয়ের উপর থেকে সরকারের প্রভাব কমে এবং সিবিআই স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে পারে।
জিএইচ/এসজি(পিটিআই)