কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে যতদিন ছিলাম, ততদিন নির্বাচনের সঙ্গে অর্থনীতির নিবিড় সম্পর্ক প্রকটভাবে চোখের সামনে ফুটে ওঠেনি৷ কারণ, নির্বাচন মানে তখন ছিল দেওয়াল-লেখা, পোস্টার-ব্যানার, জিপে করে ঘুরে ঘুরে নির্বাচনকেন্দ্রের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ঘোরা৷ মাঝেমধ্যে প্রার্থী বা দলের নেতাদের হেঁটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের ভোট দিতে বলা৷ তাতে খরচ খুব একটা বেশি হত না৷ বাম ও জনসংঘের ক্যাডার এবং কংগ্রেসের কর্মীরা ভোট এলে চেগে উঠতেন৷ ভাড়াটে কর্মী, বেসরকারি বিশেষজ্ঞ দল, প্রচারের দায়িত্বে থাকা কোম্পানি, ভোটবিশেষজ্ঞদের কথা তখন অজানা৷ খালি এটুকুই শোনা যেত, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা সব দলকেই চাঁদা দিয়ে দিতেন৷ ক্ষমতাসীন দল হলে বেশি৷ বিরোধী হলে কম৷
নির্বাচনে খরচের বহরটা প্রথমে টের পেলাম দিল্লি এসে৷ দিল্লিতে বরাবরই দেখনদারি ও বৈভবের ছড়াছড়ি৷ এখানে যেমন জন্মদিন বা বিয়ে অথবা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে এতটা ঢালাও খরচ হয়, তা ভাবা যায় না৷ যত দিন যাচ্ছে, ততই অঙ্কটা এমন লাগামছাড়া জায়গায় চলে যাচ্ছে যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়৷ ছেলেবেলায় অনেক রচনা লিখতে হয়েছে, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা নিয়ে৷ এখন দিল্লিতে অন্তত কেউ আর লাখ টাকার স্বপ্ন দেখে বলে মনে হয় না৷ রাজনীতির ক্ষেত্র হলে সেটা শয়ে শয়ে কোটির আকাশ ছোঁয়৷
কেমন সেই অঙ্ক? টাইমস অফ ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, বিজেপি ২০১৯-এর লোকসভা ও অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, সিকিম ও অরুণাচলের জন্য এক হাজার দুইশ কোটি টাকা খরচ করেছে বলে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে৷ তার মধ্যে ১৭৫ কোটি খরচ করা হয়েছে তারকা প্রচারকারীদের পিছনে, ৩২৫ কোটি মিডিয়া বিজ্ঞাপনে, ২৫ কোটি পোস্টার, ব্যানার, কাট আউটে, প্রায় ১৬ কোটি জনসভায় এবং প্রায় ২১৩ কোটির অন্য খরচ, এছাড়া আনুসাঙ্গিক খরচ আছে৷
স্ক্রোল ও নিউজ১৮ ২০১৯ সালের ৪ জুন একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে৷ সেখানে সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজের একটি রিপোর্ট উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি ২৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে৷ আর সব দল মিলিয়ে মোট খরচ করেছে ৬০ হাজার কোটি টাকা৷ সিএমএসের দাবি, অভিজ্ঞতা, ধারণা ও হিসাব কষে তারা এই অংকে পৌঁছেছে৷
রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় সিএমএসের চেয়ারপার্সন এন ভাস্কর রাও বলেছেন, এই হারে খরচ বাড়তে থাকলে ২০২৪ সালে এক লাখ কোটি টাকা নির্বাচনে খরচ করবে রাজনৈতিক দলগুলি৷ এই রিপোর্টে সিএমএস সেকেন্ডারি ইনফরমেশন, ফিল্ড স্টাডিজ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখেছে, প্রতিটি ভোটারপিছু সাতশ টাকা খরচ করা হয়েছে৷ ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা প্রচারে খরচ হয়েছে৷
সিএমএসের রিপোর্ট ঠিক না ভুল সে সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না৷ স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলি এই হিসাব মানবে না৷ তারা নির্বাচন কমিশনে যে হিসাব দিয়েছে, সেটাই চূড়ান্ত৷ সেখানে বিজেপি এক হাজার দুইশ ও কংগ্রেস ৮২০ কোটির হিসাব দিয়েছে৷ অর্থাৎ, দুইটি প্রধান দল মিলে দুই হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে৷ সেই অঙ্কটাই বা কম কীসের৷ এর পাশাপাশি বাকি রাজনৈতিক দলগুলি আছে৷ যে সব আঞ্চলিক বা জাতীয় দল কোনো না কোনো রাজ্যে ক্ষমতায় আছে, সেখানে তারাও অঢেল খরচ করে৷ প্রচুর অর্থ দিয়ে ভোট বিশেষজ্ঞ বা তার সংস্থাকে নিয়োগ করে৷ প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য ঢালাও খরচ করা হয়৷ এমনকি ভোটের আগে গরিবদের কাছে টাকা-সহ অন্য নেশার জিনিস বিলি করার অভিযোগ প্রতিবারই ওঠে৷ তাই সবমিলিয়ে বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয়৷
এই টাকা আসে কোথা থেকে? একটা সময় সিপিএম-সহ বামদলগুলি চাঁদার কৌটো নিয়ে বাড়ি বাড়ি যেত, রাস্তায় নেমে চাঁদা তুলত৷ তাতে ভোটের খরচ আসত না, তবে জনসংযোগ হত৷ আর এই প্রচারও করা যেত, আমরা সাধারণ মানুষের টাকায় চলি৷ আসলে টাকাটা তো আসে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে৷ ২০১৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলি রাজনৈতিক বন্ড থেকে নয় হাজার ২০৮ কোটি টাকা পেয়েছে৷ তারমধ্যে বিজেপি পেয়েছে পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি টাকা, কংগ্রেস ৯৬৪ কোটি ও তৃণমূল ৭৬৭ কোটি টাকা৷ এই বন্ডে টাকা দেয়ার সময় নাম জানাতে হয় না৷ তাই কে বা কোন সংস্থা দিয়েছে তা জানা সম্ভব নয়৷
তবে বোঝাই যায়, টাকাটা এসেছে মূলত শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে৷ তারা তো টাকাটা এমনি দেবে না৷ চালু কথাই আছে, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা এক টাকা দিলে তিন টাকা আদায় করে নেবে৷ তারা যদি টাকা আদায় করতে চায়, তাহলে কীভাবে করবে? নিন্দুকেরা বলে এই যে হঠাৎ হঠাৎ সবজি থেকে নানা ধরনের জিনিসের দাম বেড়ে যায়, এই যে প্রচুর টাকা হিসাবের বাইরে থাকে (যাকে কালো টাকা বলে আর কী), তার কারণ কী? শিল্পপতিদের যে নানাভাবে সুবিধা দেয়া হয়, তারই বা কারণ কি? এর জবাব তো একটাই, বোঝ মন যে জান সন্ধান৷ দল বাদ দিয়ে প্রার্থীরাও প্রচুর অর্থ খরচ করে৷
এর কতটা প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ে? বলে রাখা ভালো, অর্থনীতিও একটা বিষম বস্তু৷ ঘটনা হলো, যত অর্থ খরচ হয়, অর্থনীাতির পক্ষে তা মোটেই খারাপ নয়৷ হয়ত তা প্রডাকটিভ কাজে খরচ হচ্ছে না৷ কিন্তু প্রচুর মানুষ কাজ পাচ্ছেন, কর্মসংস্থান হচ্ছে, বাজারে টাকা আসছে৷ আর যে টাকাটা খরচ হচ্ছে, তার অধিকাংশই হলো যাকে বলে আনঅ্যাকাউন্টেড মানি৷ সেই বিপুল পরিমাণ অর্থ সিস্টেমে চলে আসছে৷ ফলে ভোটযজ্ঞে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হলেও, তার জন্য ভারতীয় অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়বে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই৷ বাস্তবে হয়ও না৷ আর এই প্রবণতা এখন কমবেশি প্রায় সব দেশেই হয়৷ নির্বাচন কমিশন যে খরচটা করে তা আগে থেকেই বাজেটে বরাদ্দ করা থাকে৷
এটা গণতন্ত্রের জন্য কতটা ভালো না খারাপ, সেটা অন্য প্রশ্ন, অর্থনীতির নিরিখে ভারতে ভোটখরচের একটাই বিরুপ প্রভাব আছে, ভোটের আগে বা পরে, তা হলো, কিছু জিনিসের দাম বেড়ে যায়৷ সেটা কাকতালীয় না তার সঙ্গে ভোটের কোনো সম্পর্ক আছে, তা পণ্ডিতরা বলতে পারবেন, আমরা আদার ব্যাপারীরা মাঝেমধ্যে একটু চাপে পড়ে যাই৷ এখন তো মেগার যুব৷ মেগা মুভি, মেগা শো, মেগা রিলিজ সবই অহরহ দেখতে পাচ্ছি৷ তা এত বড় দেশের মেগা ভোটে যদি কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয় এটা আর বেশি কোথায়? সম্প্রতি মোদী মন্ত্রিসভা ঘোষণা করেছে, ২০২৪ থেকে পাঁচ বছর গরিবদের বিনা পয়সায় রেশন দেয়া হবে৷ তার জন্য পাঁচ বছরে খরচ হবে দুই লাখ কোটি টাকা৷ কোনো সন্দেহ নেই, গরিবদের রেশন দেয়ার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সাধু ও প্রশংসনীয়৷ তার জন্য পাঁচ বছরে দুই লাখ কোটি টাকা খরচের ভার যদি বছরের পর বছর অর্থনীতি নিতে পারে, পাঁচ বছরে একবার কয়েক হাজার কোটির ভারও তা সইতে পারবে৷