ভ্যাকসিন আর দূরত্ব বাঁচাচ্ছে যৌনকর্মীদের
৬ আগস্ট ২০২১সোনাগাছির এই রাস্তাটা সন্ধের দিকে একেবারে অন্য চেহারায় থাকে৷ চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউয়ের ব্যস্ততা এমনিতেই কলকাতার যে কোনো রাস্তার চেয়ে বেশি৷ সোনাগাছির মুখে তার উপর জায়গায় জায়গায় জটলা থাকে৷ খরিদ্দারদের আগ্রহী দৃষ্টি, যৌনকর্মীদের খরিদ্দার ধরার চেষ্টা, আলো-আঁধারি রাস্তায় যেন একটু বেশি গায়ে লাগালাগি৷
সেই রাস্তা দিয়েই সোনাগাছির ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্মী (নাম পরিবর্তিত)৷ একের পর এক গলির মুখে ছোট ছোট হেল্প ডেস্ক৷ থার্মাল স্ক্যানার নিয়ে বসে আছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা৷ লক্ষ্মীর মুখে ডাবল মাস্ক, সাংবাদিককেও বাধ্য করেছে ডাবল মাস্ক পরতে৷ কিছুক্ষণ পর পরই পকেট থেকে স্যানিটাইজার বার করে হাতে লাগিয়ে নিচ্ছে৷
স্টোরির স্বার্থে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের অব্যবহিত পরে সাংবাদিককে যেতে হয়েছিল সোনাগাছি৷ করোনার একেবারে গোড়ায় এই লক্ষ্মীদের নিয়েই স্টোরি করেছিল ডিডাব্লিউ৷ লম্বা লকডাউনে কার্যত অনাহারে দিন কাটছিল লক্ষ্মীদের৷ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরে তারা কেমন আছেন, সেইটেই স্টোরির বিষয়৷
এমন সোনাগাছি সাংবাদিক দেখেনি৷ গায়ে গায়ে সোনাগাছি হঠাৎ সতর্ক হয়ে নিরাপদ দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছে৷ কেউ কারো কাছে ঘেঁসছে না৷ জায়গায় জায়গায় হেল্প ডেস্কে থার্মাল স্ক্যানারে মেপে নেওয়া হচ্ছে খরিদ্দারের তাপমাত্রা৷ সামান্য সর্দি-কাশির আভাস পেলেও তাকে চলে যেতে বলা হচ্ছে৷ একেকটি ঘরে ঢোকার মুখে স্যানিটাইজ করা হচ্ছে কাস্টমারকে৷
লক্ষ্মীর বক্তব্য, ''ঘরের ভিতরেও মাস্ক খুলতে দিচ্ছি না আমরা৷ নিজেরাও খুলছি না৷ আগেই এ কথা জানিয়ে দিচ্ছি বাবুদের৷ তাতে পোষালে ভালো, না পোষালে কিছু করার নেই৷''
খাতায় কলমে এশিয়ার সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি কলকাতার সোনাগাছি৷ শতক পুরনো এই রিপুমহলে এখন বাস করেন প্রায় সাত হাজার যৌনকর্মী এবং তাদের পরিবার৷ এছাড়াও রয়েছে ভাসমান যৌনকর্মীরা৷ যারা সোনাগাছিতে থাকেন না কিন্তু কাজের সূত্রে আসেন৷ সেই সংখ্যা হিসেব করলে মোট যৌন কর্মীর পরিমাণ ১৫ হাজারের কাছাকাছি৷ আশ্চর্য বিষয় হলো, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সেই সোনাগাছি সামলে ফেলেছে৷ মৃত্যু হয়নি একজনেরও৷ সব মিলিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ শতাংশেরও কম যৌনকর্মী৷ কীভাবে?
কিছুদিন আগে করোনাতেই মৃত্যু হয়েছে বিশিষ্ট চিকিৎসক স্মরণজিৎ জানার৷ দীর্ঘদিন ধরে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি কাজ করেছেন৷ সাংবাদিককে বলছিলেন, ''করোনার প্রথম ঢেউয়ে সম্পূর্ণ লকডাউনে ভয়ংকর অবস্থা হয়েছিল সোনাগাছির যৌনকর্মীদের৷ বোঝা যাচ্ছিল ফের লকডাউন হলে তারা না খেতে পেয়ে মরে যাবে৷'' ফলে টিকা আসার পরেই দ্রুত যৌনকর্মীদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন ডাক্তারবাবু৷ পাশাপাশি শুরু হয় সচেতনতা শিক্ষা৷
এনজিও দুর্বার ভারতের যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে৷ ঘরে ঘরে সচেতনতামূলক লিফলেট বিলি করতে শুরু করে তারা৷ যৌনকর্মীদের বোঝানো হয়, ব্যবসা করলেও কীভাবে দূরত্বের কথা মাথায় রাখতে হবে৷ মুখ থেকে মাস্ক খোলা যাবে না৷ কীভাবে নিজেদের স্যানিটাইজ করতে হবে৷এরপরেই গোটা সোনাগাছি জুড়ে বেশ কিছু হেল্প ডেস্ক তৈরি করে দুর্বার৷খরিদ্দারদের পরীক্ষা শুরু হয়৷
দুর্বারের সম্পাদক কাজল বসুর বক্তব্য, ''ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতোই সমস্ত কাজ করেছি আমরা৷ তাতে লাভও হয়েছে৷ যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের কড়া আইসোলেশনে রাখা হয়েছে৷ সোনাগাছির মতো ঘিঞ্জি জায়গায় একবার করোনা ছড়িয়ে গেলে ভয়ংকর ব্যাপার হতো৷''
দীর্ঘদিন ধরে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করছেন মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায়৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ''খুব সতর্কভাবে সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ সরকারও খুব সাহায্য করেছে৷ সে কারণেই সময় মতো সকলকে টিকা দেওয়া গেছে৷ ব্যবসা বন্ধ না করেও যে সতর্কতা অবলম্বন করা যায়, সোনাগাছি এবারে তা দেখিয়ে দিয়েছে৷''
শুধু সোনাগাছি নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত যৌনপল্লিতেই একই নিয়ম পালন করেছেন যৌনকর্মীরা৷ ফলও পেয়েছেন৷ তবে বাকি ভারতের চেহারা অবশ্য এক নয়৷ দিল্লিতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে ফের কাজ বন্ধ হয়ে যায় যৌনকর্মীদের৷ নিশার (নাম পরিবর্তিত) মতো যৌনকর্মীরা হরিয়ানায় দেশের বাড়ি ফিরে গেছিলেন, যারা বাড়ি ফিরতে পারেননি, তারা পরিচিত কাস্টমারদের বাড়ি গিয়ে অথবা হোটেলে গিয়েছেন৷ যৌনকর্মীর বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দিল্লিতে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা এক এনজিও কর্মী৷ তবে গত একমাসে দিল্লির যৌনকর্মীদেরও টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে৷ জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে তারা কাজও করতে শুরু করেছেন৷