1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভয়ে বাঁচতে হয়, বদলাতে হয় নাম

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

সংখ্যালঘুদের জীবনসঙ্গী হলো ভয়৷ অন্য সব দেশের মতো ভারতেও এটা সত্যি৷ আর সেই ভয়ের জন্যই বদলাতে হয় নাম, বদলাতে হয় পোশাক৷

https://p.dw.com/p/4GyQS
২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গার ছবি
২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গার ছবিছবি: Syamantak Ghosh/DW

আমার এক বন্ধু মাস কয়েক আগেই নয়ডায় ফ্ল্যাট কিনেছে৷ সে যখন ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার বাবা এবং দাদার রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল৷ তারা বারবার করে বন্ধুকে বলেছেন নয়ডায় ফ্ল্যাট না কিনতে৷ তাদের অনুরোধ ছিল, নয়ডা নয়, শাহিনবাগ, ওখলা, জামিয়া নগরের মতো জায়গায় গিয়ে ফ্ল্যাট কেনা উচিত৷ কেন? কারণ, হিন্দুপ্রধান নয়ডার সোসাইটিতে ফ্ল্যাট কিনলে বাবা, দাদার চিন্তায় রক্তচাপ বেড়ে যাবে৷ তারা শান্তিতে থাকবেন মুসলিম-বহুল এলাকায় ছেলে ও ভাই ফ্ল্যাট নিলে৷ আমার এই মুসলিম বন্ধু তার বাবা ও দাদার অনুরোধ রাখেনি৷ দীর্ঘদিন ধরে সে নয়ডায় থেকেছে এবং সে নয়ডাতেই থাকবে৷ ফলে অন্য রাজ্যে থাকা বাবা, দাদা-সহ পরিবারের অন্যরা ভয়ে থাকবেন৷ আশঙ্কায় থাকবেন৷ আতঙ্কে থাকবেন৷ 

এমন নয় যে বন্ধুর চিন্তা হয় না৷ এমন নয় যে দিল্লিতে যখন দাঙ্গা হয়েছিল, জামিয়া মিলিয়ায় যখন পুলিশ হস্টেলে ঢুকে ব্যাপক মারধর করেছিল, দিল্লিতে দাঁড়িয়ে ভোটের সময় জনসভায় মন্ত্রী বলেছিলেন, দেশ কে গদ্দারো কো... সমর্থকরা চেঁচিয়ে বলেছিলেন, গোলি মারো ... কো, তখন বন্ধুও আতঙ্কগ্রস্ত হয়৷ তখন তারও ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও মুসলিমবহুল এলাকায় না গিয়ে, পছন্দের নয়ডাতেই ফ্ল্যাট কিনেছে সে৷ কেন? বন্ধুর জবাব, একে তো শাহিনবাগ, ওখলা, জামিয়া নগরের মতো জায়গাগুলো খুবই ঘিঞ্জি, নোংরা৷ খোলামেলা জায়গা পাওয়া যায় না৷ বাচ্চার খেলার, স্কুলের জন্য অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়৷ নাগরিক সুবিধের কথা মাথায় রেখেই নয়ডায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে৷

এটাই তো হওয়া উচিত৷ একটা সম্প্রদায়ের মানুষ কেন শুধু সীমাবদ্ধ কয়েকটা জায়গায় থাকবেন? তারাও তো ছড়িুয়ে ছিটিয়ে থাকবেন পছন্দের জায়গায়৷ কিন্তু দিল্লি কেন, ভারতের অধিকাংশ শহরে ওই ভয়ের কারণে বা নিজেদের মানুষজনের সঙ্গে একসঙ্গে থাকার স্বস্তির জন্য মুসলিমরা ওই এলাকাগুলি পছন্দ করেন৷ একজায়গায় থাকেন৷ তাই প্রতিটি শহরেই চিহ্নিত হিন্দু, মুসলিম, শিখ মহল্লা থাকে৷ থাকে দলিত মহল্লাও৷ অবশ্য এটা শুধু হিন্দু-মুসলিম-শিখেদের মানসিকতা নয়, দিল্লিতে তো অধিকাংশ বাঙালির প্রথম পছন্দ চিত্তরঞ্জন পার্ক, কারণ এটা হলো বাঙালি এলাকা৷ এখানে ঢুকলেই আপনাদের কানে আসবে বাংলা ভাষা, বাঙালি খাবার, শাড়ির দোকান, শুনতে পারবেন বাংলা গান, দেখতে পারবেন বাংলা বই৷ একই কারণে দক্ষিণ ভারতীয়রা পছন্দ করে স্বামীনগর, কারণ, সেখানে দক্ষিণ ভারতীয়ের সংখ্যা বেশি৷ অর্থাৎ, কারণ যা-ই হোক না কেন, সংখ্যালঘু মানসিকতা একইরকমভাবে কাজ করে৷

কিন্তু তাই বলে কি বাস বা ট্রেনযাত্রার সময় নিজের নাম বদলে নিতে হয়? আমার আরেক মুসলিম বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীর অভিজ্ঞতার কথা বলি৷ দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা হলেই, বাস বা ট্রেনে সফরের সময় সে নিজের নাম বদল করে দেয়৷ সে তখন কখনো সমীর, কখনো রাজু বা কখনো পাপ্পু হয়ে যায়, যাতে কোনোভাবে মনে না হয় সে মুসলিম৷ তখন সে বাচ্চাদের, স্ত্রীকে বাড়ির বাইরে যেতে দেয় না৷ সাংবাদিক বলে নিজেকে বেরোতে হয় ঠিকই, কিন্তু তখন তাকেও ভয় তাড়া করে৷ সেই বন্ধুই বলছিল, সেসময় মুসলিমরা স্ত্রী বা বাড়ির মেয়েরা হিজাব পরে বাইরে যান না, কারণ, তাহলে তারা চিহ্নিত হয়ে যাবেন৷ তখন তারা শাড়ি পরেন৷ বুরখা তো নয়ই৷ ছেলেরাও ফেজ টুপি পরেন না৷ অর্থাৎ, দেখে যেন মনে না হয়, তারা মুসলিম৷

শুনতে শুনতে ১৯৮৪-র কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল৷ দুই দেহরক্ষীর গুলিতে মারা গেছেন ইন্দিরা গান্ধী৷ ঘটনাচক্রে দুজনেই শিখ৷ তারপর দিল্লি জুড়ে চলেছিল শিখ নিধন-পর্ব৷ সেসময় বাঁচার তাগিদে শিখরা তাদের মাথার পাগড়ি খুলে ফেলেছিলেন৷ দাড়ি কামিয়ে ফেলেছিলেন৷ নাম বদলে নিয়েছিলেন৷ ১৯৮৪-র পর শিখ-দাঙ্গা আর হয়নি৷ কিন্তু এই দিল্লিই তো সাম্প্রতিক সময়ে  হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, উত্তেজনা দেখলো কতবার৷ কতবার এরকমভাবে নামবদল করে চলতে হবে তাদের?

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লি
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

ভয় ঢুকে যাচ্ছে৷ ভয় ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে৷ প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, খাবার, পোশাক, ধর্মাচরণ নিয়ে৷ শুধু গোমাংস রাখার অভিযোগে মারা হয়েছিল আখলাককে৷ গরু পাচারকারী সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে, নির্দিষ্ট ধ্বনি না দেয়ার জন্য মারা হয়েছে৷ এ সবই তো শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় ভয়ে৷ সেই ভয় ঢুকে যায় অস্থি-মজ্জায়৷

বারাণসীতে গিয়ে সেই ভয়ের আরেক ছবি দেখেছিলাম৷ মুসলিম শাড়ি ব্যবসায়ী জানিয়েছিলেন সে কথা৷ জ্ঞানবাপী নিয়ে তখন উত্তেজনা বাড়ছে৷ সেই সময় তার কারিগররা চলে গিয়েছিলেন ভয়ে৷ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শাড়ি তৈরি৷ তারাও তখন বেরোবার আগে দুই বার চিন্তা করতেন৷

লিখতে লিখতে বড় বেশি করে মনে পড়ছে সেই বিপন্ন মুখগুলি৷ দিল্লি দাঙ্গার পর শিবিরে যাদের রাখা হয়েছিল৷ জীবন বাঁচাতে তাদের হঠাৎ সবকিছু ফেলে রেখে বাড়ি ছেড়েছিলেন৷ সেই বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল দাঙ্গাকারীরা৷ পুড়ে গিয়েছিল আধার কার্ড, ভোটার পরিচয়পত্র৷ সেই শিবিরে নতুন করে সব আবেদন করতে করতে তাদের একটাই জিজ্ঞাসা ছিল, কেন এমন হলো?

সম্ভবত, এটাই প্রায় সারা বিশ্বের সংখ্যালঘুদের চিরন্তন প্রশ্ন৷ দেশভেদে কেবল ভাষাটা বদলে যায়, প্রশ্নটা একই থাকে৷ আর থাকে ভয়, সব দেশের সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে যা সাধারণ ঘটনা৷

২০ এপ্রিলের ছবিঘরটি দেখুন...

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷