মধ্যবিত্ত বিনিয়োগ করবে কোথায়
২২ সেপ্টেম্বর ২০২১
রিনি রেজা একজন গৃহিণী৷ তিনি অনেক দিন ধরেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন৷ তার কথা এটা পেনশনের মত নিরাপদ৷ মাস শেষে বা তিন মাস পর পর লভ্যাংশ ব্যাংকেই জমা হয়৷ আর এটা দিয়ে তার সংসার খরচের বড় একটি অংশ মেটানো হয়৷ স্বামীর জমানো ও নিজের জমানো টাকা দিয়ে তিনি এই স্কিম খুলেছেন ৷ তবে এখন সুদের হার কমে যাওয়ায় তিনি বিচলিত৷ কারণ ব্যাংকে টাকা রাখলে এখন শতকরা ছয় ভাগের বেশি সুদ পাওয়া যায় না৷
আরিফুর রহমান অপু একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা৷ তার সঞ্চয়পত্র আছে৷ পরিকল্পনা ছিল অবসরে যাওয়ার সময় এককালীন যে টাকা পাবেন তা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবেন৷ তার হিসেবে তিনি দেড় কোটি টাকার মত এককালীন পাবেন৷ এটা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনলে তাকে সংসার খরচের কথা আর ভাবতে হত না৷
তিনি বলেন," শেয়ার বাজারে রিটার্ন বেশি৷ কিন্তু আস্থার সংকটের কারণে আমরা সাহস পাই না৷ আবার ব্যাংকও শতকরা ৬ ভাগের বেশি সুদ দেয় না৷ আর তেমন কোনো বিনিয়োগের জায়গা নেই৷ আমরা তো আর সরাসরি ব্যবসা করতে পারব না৷”
সঞ্চয়পত্রে আরেকজন প্রবীণ বিনিয়োগকারী আলমগীর রেজা চৌধুরী বলেন," সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমার কারণে প্রতারকেরা সুযোগ নেয়৷ তারা নানা ধরনের অফার দিয়ে, বেশি লাভের কথা বলে মানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়৷”
সরকার বাংলাদেশের পাঁচ ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ বাংলাদেশে যে সঞ্চয়পত্রগুলো আছে তারমধ্যে রয়েছে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক, পেনশনার সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র ও ডাকঘর সঞ্চয়পত্র৷
প্রত্যেক সঞ্চয়পত্রের মুনাফাই কমানো হয়েছে৷ যেমন পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়৷ এখন নতুন নিয়মে যাদের এই সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ আছে তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৩ শতাংশ হারে৷ আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে মুনাফার হার হবে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ৷ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে চলতি মুনাফাই বহাল থাকছে৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন,"১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ হলে তো আগের মতই মুনাফা দেবে সরকার৷ কিন্তু এর বেশি হলে মুনাফা কমবে৷ তারপরও ব্যাংক রেট দেখলে সঞ্চয়পত্রই এখনো বিনিয়োগের লাভজনক ও নিরাপদ জায়গা৷ শেয়ারবাজার আরেকটি ভালো জায়গা হতে পারত৷ এখানে মুনাফাও বেশি৷ কিন্তু অনিশ্চিত৷ শেয়ার বাজারে বার বার নানা ঘটনা ঘটায় মধ্যবিত্ত পুঁজি হারানোর ভয়ে সেখানে বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছে না৷”
বাংলাদেশে বন্ডে বিনিয়োগ করা যায়৷ প্রবাসীদের জন্য বন্ডে সীমাহীন বিনিয়োগের সুযোগ আছে৷ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের শরিয়াহ বন্ডে বিনিয়োগের ব্যবস্থা আছে৷ এইসব বিনিয়োগে ব্যাংক রেটের চেয়ে বেশি মুনাফা পাওয়া যায়৷
ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগের একটি সুযোগ তৈরি হতে পারে৷ তবে তারা এখনো সাধারণ মানুষের অর্থ নেয়ার অনুমতি পায়নি সরকারের কাছ থেকে৷ ড. আতিউর রহমান বলেন,"সরকারকে নিশ্চয়ই বিকল্প বিনিয়োগের পথ তৈরি করে দিতে হবে৷ সরকার গ্রিন বন্ড ছাড়তে পারে৷ তবে শেয়ার বাজার যদি সঠিক মনিটরিং-এর আওতায় আসে এবং আস্থা ফিরে পায় তাহলে এটাই হতে পারে সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র৷”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন মনে করেন,"সরকার বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করে দেবে৷ বিনিয়োগের খাত তৈরি করা তার কাজ নয়৷ শেয়ার বাজার ঠিকমত কাজ করলে ব্যাংকের সাথে তাদের প্রতিযোগিতা হতো৷ মানুষ বেশি মুনাফার জন্য শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করত৷ ব্যাংক রেটও তখন বাড়ত৷ এখন মানুষ নিরাপত্তার জন্য কম রেটে ব্যাংকে টাকা রাখতে বাধ্য হচ্ছে৷ শেয়ার বাজারের মিউচুয়্যাল ফান্ডও বিনিয়োগের একটি বড় জায়গা হতো৷ কিন্তু তা হয়নি৷”
তার কথা," করোনার কারণে সরকার আর্থিক চাপে আছে ৷ তাই সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমানো হয়েছে৷ এর একটি যুক্তিও আছে৷ যারা এই করোনার সময়ও ৫০ লাখ বা এক কোটি টাকা সঞ্চয়পত্রে রাখতে পারেন তাদের সরকার কেন সাবসিডি দেবে৷ সরকার সঞ্চয় পত্রে যে উচ্চ হারে সুদ দেয় তা তো সাবসিডি৷”
তারপরও যাদের কম বিনিয়োগ বা যারা এটার ওপর নির্ভরশীল তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা যেতে পারে৷ তার মতে,"বয়ষ্ক বা অবসরপ্রাপ্তদের জন্য একটি সিলিং বেধে দিয়ে তাদের উচ্চহারে মুনাফা দেয়া যেতে পারে৷ কিন্তু সবার জন্য নয়৷ সমস্যা হলো সেটা চিহ্নিত করা হবে কীভাবে?”
বিনিয়োগের জায়গাগুলো সংকুচিত হওয়ায় প্রতারকেরা নানা ধরনের লোভনীয় অফার দেয়৷ ই-কমার্সের নামে প্রতারণা করে৷ অনেক বেশি মুনাফার লোভে মানুষ তাদের ফাঁদে পা দেয়৷ তবে ড. আতিউর মনে করেন," লোভের কারণেই মানুষ বেশি প্রতারিত হয়৷ তাদের তো বোঝা উচিত অল্প সময়ে দুই-তিনগুণ মুনাফা পাওয়া যায় না৷ আর উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামে কীভাবে একটি পণ্য বিক্রি হয়!”