মনমোহন সিং-এর যুক্তরাষ্ট্র সফর
২ অক্টোবর ২০১৩জাতিসংঘের সাধারণসভার অধিবেশনে বক্তব্য রাখা একটা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার হলেও চারদিনের যুক্তরাষ্ট্র সফরসূচির প্রধান লক্ষ্য বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদের সঙ্গে পারর্স্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে মত বিনিময় এবং নিজেদের অবস্থান তুলে ধরা৷ তাতে প্রধানমন্ত্রী ড. সিং কতটা কী পেলেন বা দিলেন, অর্থাৎ তাঁর নিটফল কী হলো, তাতে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা খুব একটা আশান্বিত নন৷ এই ধরণের বৈঠকে বড় রকম সাফল্যের আশাও কেউ করেননি৷ আর এই প্রশ্ন নিয়েই ভারতের রাজনৈতিক অলিন্দে চলছে বিচার-বিশ্লেষণ৷
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং প্রত্যাশিতভাবেই তিস্তা চুক্তি এবং স্থলসীমা চুক্তি বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন৷ বাংলাদেশে নির্বাচনের আর দেরি নেই, সেটা জেনেই তার আগে যাতে এই দুটি চুক্তি কার্যকর হয় সেজন্য দিল্লি সবভাবে চেষ্টা করে যাবে৷ এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সলমান খুরশিদ ইস্যু দুটির অগ্রগতির বিশদ ব্যাখ্যা দেন শেখ হাসিনাকে৷ আগামী সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে স্থলসীমা সংক্রান্ত বিলটি পাশ করাবার জন্য নতুন করে চেষ্টা চালানো হবে বলে তাঁকে জানান৷ বিরোধী দল বিজেপিসহ অন্যান্য দলের সমর্থন যাতে পাওয়া যায়, তার জন্য তাদের বোঝানো হবে৷ উল্লেখ্য, স্থলসীমা চুক্তি সই হয়েও তা কার্যকর করতে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন দরকার৷
তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি সম্পর্কে শেখ হাসিনাকে বলা হয় যে, বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই চুক্তি অনুযায়ী তার প্রাপ্য জলের পুরোটাই পাচ্ছে৷ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে তিস্তা চুক্তি করা না গেলেও জল ভাগাভাগিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না৷ কাজেই বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কারণ নেই৷ সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তি খারিজ করে দিতে পারে, কিন্তু ভারতের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে রাজনৈতিক সমীকরণের কথা মাথায় রেখে সেটা করা যাচ্ছে না৷ প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে অবশ্য আশ্বাস দেয়া হয় যে, মমতা বন্দোপাধ্যায়কে আবারো বোঝাতে সলমান খুরশিদকে কলকাতায় পাঠানো হবে৷
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠকের নিটফল, দু'দেশের নিয়ন্ত্রণ রেখায় সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশ রোধে এই প্রথম দু'দেশের সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশন স্তরে একটা ‘মেকানিজম' গঠনে ঐকমত্য হয়৷ বলা হয়, নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর শান্তি স্থাপিত হলে পরবর্তী পর্যায়ে আবার নেয়া হবে পারস্পরিক আস্থা বাড়ানোর অন্যান্য পদক্ষেপ৷ পর্যবেক্ষকদের মতে, দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক একটা ইতিবাচক লক্ষণ হলেও অতীতের মতো এবারও অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ, আশ্বাস প্রতিআশ্বাসই সার হবে৷ কূটনৈতিক বাক্যবন্ধে চিঁড়ে ভিজবে না৷ ভূমিগত বাস্তবতায় তার প্রতিফলন হবার সম্ভাবনা কম৷ সেটা বোঝা গেছে, সাধারণ পরিষদে ভারত সন্ত্রাস ইস্যুতে যেমন কড়া বার্তা দিয়েছেন, তেমনি পাকিস্তান কাশ্মীরে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের দাবির কথা তুলেছে৷
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে শীতলতা কাটিয়ে একটা বোঝাপড়ায় আসার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে৷ যেমন, প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা সিস্টেমের যৌথ উদ্ভাবন ও উৎপাদন৷ ২০১৪ সালে প্রশান্তমহাসাগরীয় উপকূলবর্তী দেশগুলির সামরিক মহড়ায় যোগ দিতে ভারতের সম্মতি৷ বেসামরিক পরমাণু বাণিজ্য-চুক্তির দায়বদ্ধতা শর্ত কিছুটা শিথিল করতে রাজি হওয়া ইত্যাদি৷ ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে পদ্ধতিগত নানা জটিলতা দূর করার আশ্বাস দেন ওবামাকে প্রধানমন্ত্রী ড. সিং৷ যদিও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভারতের নির্ভরতা ক্রমশ বাড়তে থাকাটা ভালো চোখে দেখছে না রাশিয়া৷ মোটকথা, দেখা-সাক্ষাৎ আর সরকার প্রধানদের মন বোঝা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই আনতে পারেননি ড. সিং৷