মনোনয়নের শেষ দিনে শুধুই সন্ত্রাস, গুলি-বোমা, মৃত চার
১৫ জুন ২০২৩তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীদের তাণ্ডবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় শেষদিনেও মনোনয়ন পেশ করতে পারলেন না বিরোধী প্রার্থীরা। বিভিন্ন জায়গায় বিরোধীদের আটকাতে সমানে গুলি চলেছে। বোমা পড়েছে। বাম-কংগ্রেস প্রার্থীরা একজোট হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে বেধড়ক মার খেয়েছেন। এভাবে গায়ের জোরে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঠেকিয়ে লড়াই ছাড়াই তৃণমূল জিততে চেয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বৃহস্পতিবার সন্ত্রাসের বলি হয়েছেন চারজন। চোপড়ায় সিপিএম কর্মী মারা গেছেন। আর ভাঙড়ে মারা গেছেন তিনজন, দুইজন আইএসএফের এক কর্মী এবং একজন তৃণমূল কর্মী। আইএসএফ দাবি করেছে, তাদের তিনজন কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। সিপিএম নেতা বিমান বসুর দাবি, চোপড়ায় দুইজন সিপিএম কর্মী মারা গেছেন। তাদের দাবি সত্য়ি হলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ছয়।
মনোননপত্র জমা দিতে না পেরে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রার্থীরা মরিয়া হয়ে কলকাতা হাইকোর্টে চলে যান। সেখানে সিপিএম-আইএসএফের একটি আবেদনের শুনানিও ছিল। প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দেন, কলকাতা পুলিশ প্রার্থীদের এসকর্ট করে নিয়ে গিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার ব্যবস্থা করবে। ক্যানিং, ভাঙড়, কাশীপুর, বসিরহাট থেকে প্রার্থীরা হাইকোর্টে এসেছিলেন। তবে এই নির্দেশ যখন এসেছে, তার এক ঘণ্টার সামান্য পরেই মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় শেষ হওয়ার কথা।
কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী কমিশনকে চিঠি লিখে দাবি জানিয়েছেন, শুক্রবারও মনোনয়নপত্র পেশ করতে দিতে হবে।
আদালতের নির্দেশ অমান্য?
হাইকোর্টের বিচারপতি মান্থা নির্দেশ দিয়েছিলেন, ভাঙড়ে ৮২ জন আইএসএফ প্রার্থীকে পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে নিয়ে যাবে। পুলিশ যখন তাদের নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সোদপুর বাজার এলাকায় দুষ্কৃতীরা তাদের ঘিরে ধরে। পুলিশ চলে যায় বলে অভিযোগ। দুষ্কৃতীরা আইএসএফের প্রার্থীদের উপর হামলা চালায়।
বিরোধীদের অভিযোগ, হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করেছে পুলিশ-প্রশাসন। পুলিশ প্রহরার মধ্যে কী করে প্রার্থীদের উপর হামলা হয়। পরে তারা বিডিও অফিসে এসে পৌঁছান।
বিকেল পাঁচটার সময় ভাঙড়ের বিডিও আইএসএফের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র পেশ করতে অনুমতি দেন।
চোপড়ার ঘটনা
উত্তর দিনাজপুরে চোপড়ায় বাম-কংগ্রেস প্রার্থীরা বুধবার পর্যন্ত মনোনয়নপত্র পেশ করতে পারেননি। বৃহস্পতিবার তারা সবাই মিলে মিছিল করে যাচ্ছিলেন মনোনয়নপত্র পেশ করতে। কাঁঠালবাড়িতে তাদের মিছিল আক্রান্ত হয়। অভিযোগ, তৃণমূলের কর্মীরা গুলি চালায়। টিভি-তে দেখা যায়, রড, লাঠি, মোটা গাছের ডাল নিয়ে বাম ও কংগ্রেস প্রার্থীদের মারা হয়। তারপর গুলি চলে।
আহতদের কাঁধে করে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যান বাম-কংগ্রেস কর্মীরা। তিনজন আহতকে ইসলামাবাদ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের শরীরে গুলি লেগেছিল। তার মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়। অন্য দুইজনের আঘাত গুরুতর। এই তিনজন ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
হাসপাতালে ভর্তি এক আহত বলেছেন, ''আমরা মিছিল করে যাচ্ছিলাম। তৃণমূল আক্রমণ করলো। ওরা আমাদের যেতে মানা করছিল। বড় বড় বন্দুক দিয়ে গুলি করলো। আমার এবং আমার ভাইপোর গুলি লেগেছে।''
বাম ও কংগ্রেস কর্মীরা মিছিল করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার ধারেকাছে কোনো পুলিশ ছিল না। ঘটনার পর পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয়, ইসলামপুর থেকে পুলিশ পাঠানো হয়।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেছেন, ''এটা খুনি তৃণমূলের আক্রমণ। চোপড়াতে দশজন কংগ্রেস নেতাকে অপহরণ করে একটা স্কুলে আটকে রাখা হয়। আমি কমিশনকে চিঠি লিখে বলেছিলাম, চোপড়ার অবস্থা অগ্নিগর্ভ।''
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ''বিডিও অফিসের ভিতরে তৃণমূলের কর্মীরা বসে আছে। বিভিন্ন জায়গায় সিপিএম কর্মীদের গ্রামে আটকে দেয়া হয়েছে। গুলি-বন্দুক ছাড়া তৃণমূলের কাছে আর কিছু নেই।''
তৃণমূলের চোপড়ার বিধায়ক হামিদুল রহমানের দাবি, ''বামেদের দুই গোষ্ঠীর গোলমালের জেরে গুলি চলেছে। বিরোধীরা নাটক করছে।''
সাবেক পুলিশ কর্তা সলিল ভট্টাচার্য এবিপি আনন্দকে বলেছেন, মনোনয়নের প্রথম দিন হত্যা দিয়ে শুরু হয়েছিল। মনোনয়নপত্র পেশ করার শেষদিনেও তাই। বলা হয়েছিল, বিডিও অফিসের সামনে ১৪৪ ধারা থাকবে। সেটা তো প্রহসনে পরিণত হয়েছে।'' তিনি বলেছেন, একটা অসহনীয় নীরবতার মধ্যে দিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন কাজ করছে। তাদের কোনো হেলদোল নেই। বিরোধীদের কোনো জায়গা নেই। আদালত আর কত করবে। আদালত তো আর মনোনয়ন দাখিল করাতে পারবে না। মানুষকে বোকা বানাতে ড্রোন দেখানো হচ্ছে। মানুষ অসহায়।''
ভাঙড়েও বোমা
গত দুই দিন ধরে ভাঙড়ে নওসাদ সিদ্দিকির দল আইএসএফের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র পেশ করতে দেয়া হয়নি। সমানে গুলি চলেছে, বোমার আওয়াজে কেঁপে উঠেছে ভাঙড়। বিডিও অফিস ঘিরে রেখেছিল তৃণমূলের কর্মীরা। তারা প্রকাশ্যেই বলেছে, আইএসএফ প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র পেশ করতে দেয়া হবে না।
বৃহস্পতিবার শেষদিনেও একই ঘটনা ঘটেছে। বিডিও অফিসের সামনের এলাকা শাসন করেছে তৃণমূল কর্মীরা। সমানে বোমা পড়েছে। সকাল থেকে এই পরিস্থিতি ছিল ভাঙড়ে। প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হলেও বহু প্রার্থী মনোনয়নপত্র পেশ করতে পারেনি বলে বিরোধীদের অভিযোগ। বিডিও অফিসের সামনে সমানে বোমা পড়ে। গুলি চালানো হয়। কোনো বিরোধী মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি।
ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজারে একের পর এক গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বোমা ও গুলির বৃষ্টি হয়। সংবাদমাদ্যমকে লক্ষ্য করেও গুলি ও বোমা ছোড়া হয়।
আদালতে ভর্ৎসিত কমিশন
নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগ করা নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে গিয়েছিল। কমিশনের বক্তব্য ছিল, তারা কোনো জেলাকেই স্পর্শকাতর বলে মনে করছে না। প্রধান বিচারপতি বলেন, ''আমরা কি গোটা রাজ্যেই কেন্দ্রীয় বাহিনী নামাতে বলব? আমরা একটা নির্দেশ দিয়েছি। আমরা নজর রাখছি। নির্দেশ মানা না হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব। নির্দেশ ফেলে রাখার জন্য দেয়া হয়নি।''
প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ''চাইলে সর্বোচ্চ আদালতে যেতে পারেন।''
আক্রান্ত সাংবাদিকরাও
পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে সবমিলিয়ে তিনজন মারা গেলেন। প্রচুর মানুষ আহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার চোপড়ার মিছিলেই বহু মানুষ আহত হয়েছেন।
ভাঙড়ে অন্তত দুইজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। বহু জায়গায় সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকদের ভয় দেখানো হয়েছে। হাতের বুম কেড়ে মাটিতে ফেলে দেয়া হয়েছে। ছবি তুলতে দেয়া হয়নি।
ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজারে সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছে। সমানে বোমা মারা হয়েছে। বারবার তেড়ে যাওয়া হয়েছে সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকদের দিকে। তাদের অপরাধ, তারা গাড়িতে আগুন জ্বালানোর ছবি, সন্ত্রাসের ছবি দেখাচ্ছিলেন।
পুলিশ সব দেখেও প্রথমে পিছনে চলে য়ায়। তারপর কিছুক্ষণ পর এসে অন্য গলি দিয়ে বেরিয়ে যায়।
মুখ্যমন্ত্রীর দাবি
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের দাবি, ''এই হিংসার সঙ্গে তৃণমূল জড়িত নয়। চোপড়ায় সিপিএম সব কিছু করেছে। ভাঙড়ে আইএসএফ। আমরা বদলা চাই না। কিন্তু সবকিছু একতরফা হবে না।''
জিএইচ/এসজি (পিটিআই, এবিপি আনন্দ, টিভি৯)