1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মব জাস্টিস, প্যারাডক্সের বাংলাদেশ ও ব্যানানা রিপাবলিক

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশকে এখন একটি প্যারাডক্সের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, যেখানে ‘উন্মত্ত জনতার শাসন' ‘আইনের শাসন'-কে ছাপিয়ে যাচ্ছে।

https://p.dw.com/p/4kcoC
আগুনে পুড়ে যাওয়া একটি কারখানা
নারায়ণগঞ্জের একটি টায়ার কারখানায় লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনায় বেশ কয়েকজনের হতাহতের ঘটনাও ঘটেছেছবি: Md. Amir/DW

দেড় মাস আগেও দেশটিতে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস' ছিল সমস্বরে উচ্চারিত জনতার প্রতিস্বর। সেখানে এখন ‘মব জাস্টিস' দেশটির সরকারের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও উন্মত্ত ‘জনতা' প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। আবেগ দখলে নিচ্ছে বিবেক বা যুক্তির জায়গাকে, প্রতিযোগিতার স্থান দখল করছে প্রতিহিংসা। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে এখন মানুষের কৃতকর্মের বিচার আদালতে হচ্ছে না, বরং উন্মত্ত জনতার আদালতে যেখানে জনতার দ্বারা লেবেলযুক্ত অভিযোগগুলো তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ না করেই অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। উন্মত্ত জনতা শুধু জনসমক্ষে হেনস্তা, মারধর ও অপমান করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, ভাংচুর-লুটপাট-অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করছে না, কোথাও কোথাও গণপিটুনি দিয়ে অভিযুক্তকে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় সমাজের সব স্তরের মানুষ এমনকি সরকারের খুব বেশি ভাবাবেগ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। উল্টো মব জাস্টিসকে জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে জাস্টিফাই করার চেষ্টাও দেখা যাচ্ছে। ‘যত দোষ – জনরোষ' বলে উন্মত্ত জনতার উপর দায় চাপিয়ে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের রক্ষাকারীরা নিজেদের দায় সেরে ফেলছেন। মব জাস্টিসের প্রতি কুশনের মতো সরকারের নরম তুলতুলে প্রতিক্রিয়া সমস্যাটির মাত্রার ব্যাপকতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকারের মনে রাখা উচিত, মলয়-পর্বতের ছোঁয়ায় যেমন বাঁশ চন্দনে পরিণত হয় না, তেমনি অন্তঃসার শূন্যদের উপদেশ দিয়ে কিছু ফল হয় না। কারণ গত দুই দশকে বিশ্বে এমন কিছু দেশের নজির তৈরি হয়েছে যে দেশগুলো মব জাস্টিসের বিস্তারের কারণে ‘ব্যানানা রিপাবলিকে' পরিণত হয়েছে।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে গণসহিংসতামূলক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। গণঅভ্যুত্থানের পর প্রতিদিন খবরের কাজগুলোতে দেশের কোথাও না কোথাও মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে চিকিৎসা কেন্দ্র, রাস্তাঘাট-বাজার থেকে প্রশাসনের সর্বোচ্চ কেন্দ্র সচিবালয়, মাজার থেকে আদালত প্রাঙ্গণ সবখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। সরকার ও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এসব ঘটনাকে মব জাস্টিস হিসেবে মন্তব্য করলেও এগুলো প্রতিরোধে তেমন কোনো শক্ত পদক্ষেপ নিতে এখনও দেখা যায়নি। বরং কিছু কিছু ঘটনায় সরকারের অতি নমনীয় মনোভাব দেশের মানুষকে শুধু ভাবিয়ে তুলছে না, বরং এসব ঘটনায় সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যেমন, ৪৫ জন শিক্ষার্থীর সচিবালয়ে গিয়ে মব জাস্টিসের প্রদর্শনীতে দেশের ১১ লাখ ২৮ হাজার ২৮১ জন এইচএসসি পরীক্ষার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেলেছে সরকার। এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা আদৌ এমন সিদ্ধান্ত চেয়েছেন কিনা সে বিষয়টি ভেবে দেখার প্রয়োজনই মনে করেনি সরকার।

মব জাস্টিস হলো বিচারবহির্ভূত শাস্তি বা প্রতিশোধের একটি রূপ যেখানে অন্যায়ের জন্য সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে সাধারণত অপমানিত করা হয়, মারধর করা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে ভিজিল্যান্ট বা জনতা খুন করতেও দ্বিধা করে না। তাত্ত্বিকরা একে নানা শব্দবন্ধে পরিচিত করার চেষ্টা করেছেন। যেমন 'মব লিঞ্চিং', 'মব অ্যাকশন' বা 'জঙ্গল জাস্টিস'। জঙ্গল জাস্টিসকে জনতা বা রাস্তার বিচার হিসাবেও উল্লেখ করা হয়। এটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দিকে পরিচালিত করে।

তাত্ত্বিকরা গবেষণার মাধ্যমে মব জাস্টিসের সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ রূপের অনেক নমুনা দেখিয়েছেন। সর্বোচ্চ পর্যায়টি হলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে হস্তান্তর করার পরিবর্তে সন্দেহভাজন বা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ভিড়ের মধ্যে আক্রমণাত্মকভাবে শাস্তি, মারধর, আঘাত বা হত্যার মাধ্যমে জনবিচার করা। বাংলাদেশে আমরা দেখলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশে এমন গণপিটুনি বা মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনা আগেও ঘটেছে। ছেলেধরা ও ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে ২০১৮ সাল থেকে অনেক মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশকেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সাড়ে ৬ বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ২৮৬ জন। এমনকি ২০২৪ সালে নির্বাচনের পর থেকে জুলাই পর্যন্ত গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল ৩২ জন। শুধু ঢাকাতেই নিহত হয় ১৬ জন। আগের গণপিটুনির ঘটনাগুলোকে গুজবের কারণে সৃষ্ট জনতার উন্মত্ত আচরণ হিসেবে পুলিশ ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা জাস্টিফাই করার চেষ্টা করতেন। ৫ আগস্টের পর থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে সম্পর্কে বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে গণপিটুনি ও গণঅসন্তোষের ঘটনাগুলো ঘটছে। তবে আদালত প্রাঙ্গণে যে প্রক্রিয়ায় ও পরিমাণে ‘মব জাস্টিস' বা ‘উন্মত্ত জনতা'র অভিযুক্তদের ওপর আক্রমণ চালানোর ঘটনা ঘটেছে, তা বাংলাদেশের আইনের শাসনের প্রক্রিয়াকে অনেক বড় প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। খুলনায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সেনা, নৌ ও পুলিশ সদস্যদের সামনে ১৫ বছরের এক কিশোরকে পিটিয়ে আহত করার ঘটনাটি বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আরো কোণঠাসা করে ফেলছে। আদালত প্রাঙ্গনে ও পুলিশের সামনে যে-কোনো মানুষের এমন হামলার শিকার হওয়া কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ ধরনের ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

উদ্বেগের বিষয় হলো, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মব জাস্টিসের যেসব ঘটনা ঘটেছে তার সাথে বাংলাদেশে ৫ আগস্টের পর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এমনকি বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দপ্তর ঘটনাগুলোর প্রতি যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তার সাথেও বিশ্বের অনেক দেশের সরকারের অতীত প্রতিক্রিয়ার মিল আছে। ফলে একটি আশঙ্কার কথা তুলে ধরা যেতেই পারে। সেটি হলো সেসব দেশের ভাগ্যে যে রাজনৈতিক পরিণতি ঘটেছিল তেমন পরিণতি কি বাংলাদেশকেও ভোগ করতে হবে?

২০১৬ সালের ২৬ জুলাই ডিডাব্লিউতে ‘হোয়েন দ্য মব রুলস: জাঙ্গল জাস্টিস ইন আফ্রিকা' শিরোনামে প্রকাশিত এক স্টোরিতে বলা হয়, আফ্রিকা মহাদেশে প্রতিদিন কমপক্ষে একজন ব্যক্তি বিচারক, জুরি এবং জল্লাদ হিসাবে নির্ধারিত ক্ষুব্ধ নাগরিকদের হাতে নির্যাতন বা এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখি হতেন। লিবিয়া, ঘানা, উগান্ডা, সিয়েরা লিওন, ক্যামেরুন এবং নাইজেরিয়ায় এ ধরনের জঙ্গল জাস্টিসের প্রবণতা বেশি। সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলে বিশেষ করে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশগুলোতে জঙ্গল জাস্টিস বা জঙ্গলের বিচার যেন মানুষের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর শত শত মানুষ এই দেশগুলোতে গণসহিংসতার শিকার হচ্ছে। হেলব্লিং তার গবেষণা নিবন্ধে বলেছেন, নাইজেরিয়ায় গণপিটুনির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিনের খবরের শিরোনাম হচ্ছে। ইথিওপিয়াতে মব জাস্টিসকে জাতীয় মহামারি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গৃহযুদ্ধ পরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পূর্ব ইউরোপ এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের মতো অনেক আধুনিক সংঘাত-পরবর্তী রাজ্যে মব জাস্টিসের অনেক উদাহরণ আছে। এসব ঘটনার সাথে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর মিল আছে। ধর্মের কারণে, রাজনীতির কারণে, যুদ্ধের কারণে যেসব দেশের মানুষ বারবার আক্রান্ত হয়েছে সেসব দেশের মব জাস্টিসের ঘটনাগুলোর সাথে বাংলাদেশর সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ২০২০ সালে প্রকাশিত আফ্রোব্যারোমিটারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদালত প্রাঙ্গনে উগান্ডাতে মবজাস্টিসের ঘটনা সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

উপরে উল্লিখিত দেশগুলোতে যখন মব জাস্টিসের ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করেছিল তখন দেশগুলোর সরকারের আচরণ ছিল নমনীয়। তাত্ত্বিকরা এ ধরনের আচরণকে কুশনের সাথে তুলনা করে সরকারগুলোর নরম ও তুলতুলে স্বভাবের কথা তুলে ধরেছেন। অধিকাংশ গবেষণাতেই মন্তব্য করা হয়েছে, সরকারের নমনীয় ও কার্যত ‘দেখেও না দেখার ভান করা' আচরণের জন্য এসব দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর রকমের নাজুক অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে। গবেষকরা আরো দেখিয়েছেন যে, যেসব দেশে এখন মব জাস্টিস খুব সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে সেসব দেশে একটি প্যারাডক্ম কাজ করে। সেটি হলো দেশগুলো একসময় গণতন্ত্রের জন্য, দেশগুলোর জনগণ নিজেদের ন্যায্য অধিকারের জন্য রক্ত দিয়েছিল। কিন্তু অধিকার ফিরে পাওয়ার পর সাময়িকভাবে মব জাস্টিসের ঘটনাগুলোকে এতটা হালকা ও নমনীয়তার সাথে দেখা হয়েছিল যে সময়ের বিবর্তনে ডেমোক্রেসির ধারণা ওক্লোক্রেসিতে পরিণত হয়েছিল। ওক্লোক্রেসি হলো এমন একটি সরকার যেখানে কর্তৃত্ব দৃশ্যত সরকারের হাতে থাকার পরিবর্তে বহু মানুষ বা মবের হাতে থাকে এবং গণতন্ত্রের অপব্যবহার হয় প্রতিনিয়ত।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো, ২০২০ সালের পর থেকে প্রকাশিত অনেকগুলো গবেষণায় গবেষকরা দেখিয়েছেন, মব জাস্টিস কয়েকটি রাষ্ট্রে এমন মহামারি আকারে ছড়িয়েছে যার পরিণামে দেশগুলো 'ব্যানানা রিপাবলিকে' পরিণত হয়েছে। বানানা রিপাবলিকগুলোতে রাজনৈতিক পরিমন্ডলে সবসময় অস্থিশীলতা বজায় থাকে। সেনা অভ্যুত্থান এসব দেশগুলোতে নিয়মিত ঘটনা যেখানে ব্যবসায়ী কিংবা কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে রাষ্ট্র জিম্মি হয়ে পড়ে। বানানা রিপাবলিক ব্যর্থ রাষ্ট্রের মতই নেতিবাচক অর্থ বহন করে।

মব জাস্টিসের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণে মনোবিজ্ঞানীরা নানা কারণে জনতার মনোজগতের বৈকল্যকে দায়ী করে থাকেন। আবেগ ও বিবেকের বশবর্তী হয়েই মানুষ কাজ করে। কিন্তু আবেগ আর বিবেকের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। মানুষ যখন শুধু আবেগ তাড়িত হয়ে পরিচালিত হয় তখন বিবেক দৌঁড়ে পালায়। আবেগ তাড়িত হয়ে কাজটি সম্পাদনের পর মানুষের মাঝে বিবেকের বোধ হয়তো কখনও কখনও ফিরে আসে। কিন্তু ঘটে যাওয়া সর্বনাশের প্রতিকার আর করা যায় না। সরকারের পক্ষে বা সরকারের দায়িত্বে যারা থাকেন তাদের আবেগ তাড়িত হয়ে বা আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করার যেমন সাংবিধানিকভাবে কোনো সুযোগ নেই তেমনি জনগণের কোনো অংশের আবেগতাড়িত অমানবিক কাজকে প্রশয় দেয়ার যৌক্তিকতা নেই। এ ধরনের কাজগুলোর প্রতিরোধে রাষ্ট্রের দায় সবচেয়ে বেশি। কারণ অন্যায়ের প্রতি রাষ্ট্রের সহনশীল হওয়ার কোনো সুযোগ থাকতে পারে না। কেউ অভিযোগ করুক বা না করুক রাষ্ট্রের উচিত বিষয়গুলো অনুসন্ধান করা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আদালতে পুলিশি বেস্টনীর মধ্যে অভিযুক্তদের ওপর হামলা চালিয়েছিল আইনজীবীরা। এ ধরনের ঘটনার শুরুতেই শারীরিক আক্রমণের সাথে জড়িত আইনজীবীদের বিরুদ্ধে পেশাগত দিক থেকে ব্যবস্থা নেয়া হতো তাহলে অন্যান্য সেক্টরে পরে এত বাজে পরিস্থিতি তৈরি হতো না। একজন আইনজীবী যখন আদালতের সামনে আইনের লঙ্ঘন করেও পার পেয়ে যান তখন সমাজের অন্য শ্রেণী-পেশার মানুষ আস্কারা পেয়ে যাবে। এটা খুব সহজাত বিষয়।

মনে রাখতে হবে, মব জাস্টিস একটি ব্যর্থ ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার অভিব্যক্তি। ট্রেনর ও তার সহকর্মীরা ২০২১ সালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন, যখন জনগণ স্থানীয় সরকার এবং আইন প্রয়োগকারীকে অকার্যকর এবং অবিশ্বস্ত বলে মনে করে তখন মব জাস্টিসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সেজন্য উন্মত্ত জনতাকে তাই দমিয়ে রাখতে অবশ্যই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এর জন্য যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে ফৌজদারি অপরাধের শাস্তির বিধান করতে হয়। তা না করে উল্টো বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সম্মিলিত হত্যা ও লাশের ওপর নৃত্য করতে অতীতেও দেখা গেছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত একটি গণপিটুনির ঘটনায় বিচারের নজির পাওয়া যায়। ২০১১ সালের ১৭ জুলাই আমিন বাজারে ছয় ছাত্রকে গণপিটুনিতে হত্যা করার অপরাধে ১০ বছর পর আদালত ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনকে কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন।

আহমদ ছফা লিখেছিলেন, প্রতিটি জাতির জীবনে মাঝে মাঝে কিছু কিছু গ্রন্থিচ্যুত সময়সন্ধি দেখা দেয় যখন জাতি নানান ধারায়, উপধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সময়সন্ধি যে কোন জাতির জন্যে একটা মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে আসে। এরকম পরিস্থিতিতে জাতির মধ্যবর্তী অন্তর্বিরোধ এমন প্রবল, এমন বেগবান হয়ে ওঠে, যে কেউ কাউকে বুঝতে চায় না। এখনকার বাংলাদেশও সেরকম একটি সময়সন্ধি অতিক্রম করছে। আবার একটি দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির যখন অবনতি হলে তখন নানা ধরনের গ্রুপ এবং দল থাকে যারা ওই পরিবেশের সুযোগ নিতে চায়। এমন পরিস্থিতিতে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই সর্বোচ্চ কার্যকরী পন্থা। রবীন্দ্রনাথের গানের একটি পঙক্তি মনে রাখা যেতে পারে: রাজদণ্ড যত ক্ষয় হয়, তত তার অক্ষমতা, তত তার ক্ষয়।