অভিযান নিয়ে বিএনপির শঙ্কা
২৩ মে ২০১৮গত ১৪ মে থেকে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানের অন্যতম অংশ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এ পর্যন্ত ৪৬ জন নিহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রের খবরে জানা গেছে৷ মঙ্গলবার দিবাগত রাতেও বিভিন্ন জেলায় ন'জন নিহত হয়েছেন৷ একদিনে সবোর্চ্চ ১১ জন নিহত হয়েছেন সোমবার রাতে৷ আর একক জেলা হিসেবে যশোরে সর্বোচ্চ সাতজন নিহত হয়েছেন৷
এরইমধ্যে অভিযোগ উঠেছে এই অভিযানে এখনও পর্যন্ত যারা নিহত হয়েছেন, তারা মাদক বহনকারী, খুচরা ব্যবসায়ী এবং মাদকসেবী৷ অথবা কেউ কেউ আগে মাদক ব্যবসা করতেন, এখন ছেড়ে দিয়েছেন৷ যুবলীগ এবং যুবদলের দু'জন স্থানীয় পর্যায়ের নেতাও আছেন এদের মধ্যে৷ তবে মূল হোতারা ধরা-ছোয়ার বাইরে রয়েছেন৷ তাই আলোচনায় উঠে এসেছে কক্সবাজারের (কক্সবাজার-৪ আসন) আওয়ামী লীগ দলের সংসদ সদস্য বদিউর রহমান বদি৷ তাঁকে ইয়াবা পাঁচারে বাংলাদেশের ‘রিং লিডার’ বলে ধারণা করা হয়৷
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর তালিকাতেও তাঁর নাম রয়েছে৷ স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মঙ্গলবার বদিকে গ্রেপ্তার করা হবে কিনা – সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তবে কোনো তথ্য প্রমাণ নাই৷’’ তাই তিনি বদির বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকলে তা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷
আইন ও সালিশ কোন্দ্রের (আসক) সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে যারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গেও যুক্ত৷ আমরা বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানি যে মাদক ব্যবসার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, এমপি, পুলিশ, এমনকি মাদকদদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকজনও জড়িত৷ আর সংসদ সদস্য বদিউর রহমান বদির নামও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে বার বার উঠে এসেছে৷ কিন্তু এই অভিযানে যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন বা বন্দুকযুদ্ধ নিহত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে তালিকার আলোচিত কাউকে দেখছি না৷ তাহলে প্রশ্ন উঠছে, এই বন্দুকযুদ্ধে নিহতের মাধ্যমে কি মূল হোতাদের আড়াল করা হচ্ছে?’’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ক্রসফায়ার দিয়ে বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল ও একবারে নির্মূল করার জন্যই এই সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করছে৷’’ বুধবার সকালে ঠাকুরগাঁও শহরের কালীবাড়িতে নিজের বাসভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ সব কথা বলেন৷
তাঁর কথায়, ‘‘এই ক্রসফায়ার নিয়ে দেশের মানুষের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে৷ এমন একটা সময় যখন নির্বাচন সামনে ও সরকারের শেষ বছর, ঠিক তখনই দেশে একটা যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরাও মাদকবিরোধী অভিযান চাই৷ তবে এটা অরাজনৈতিক হতে হবে৷ মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ক্রসফায়ার দিতে হবে, এমনটি যেন না হয়৷ আমরা আগেও বলেছি, মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে৷ কিন্তু যে সব যুক্তি খাড়া করানো হচ্ছে, সেগুলো কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে যুক্তি বলে বিবেচিত হওয়ার কথা নয়৷’’
একদিন আগে, অর্থাৎ মঙ্গলবার, ঢাকায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মাদকের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দলের ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন বলেন, ‘‘সারা দেশে মাদকবিরোধী যে অভিযান চলছে, তাতে দেশের মানুষ খুশি৷ মানুষ এ অভিযানের প্রশংসা করছে আর সেটা বিএনপির ভালো লাগছে না৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারের কোনো ভালো কাজ বিএনপির ভালো লাগবে না, এটাই তো স্বাভাবিক৷ কথায় আছে না, ‘যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা৷’ সরকার জনগণের স্বার্থে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে অবস্থান নিয়েছে৷ এটা সর্বনাশা ধ্বংসের পথ থেকে তরুণ সমাজকে ফিরিয়ে আনার একটি যুগান্তারী পদক্ষেপ৷’’
সরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘‘মাদকবিরোধী অভিযানে কোনো ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটছে না৷ যারা মারা যাচ্ছেন, তারা বন্দুকযুদ্ধে মারা যাচ্ছেন৷ এরা তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী৷ সরকার অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে৷ এ পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি মাদক ব্যবসায়ীকে অভিযানে আটক করা হয়েছে৷ এই অভিযান চলবে৷ আমরা মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি৷’’
সরকারের এই বক্তব্য নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা মাদকবিরোধী অভিযানের পক্ষে৷ কিন্তু কোনোভাবেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করি না৷ যারা অপরাধী, তাদের আটক করে আইনের মাধ্যমে শান্তি দেয়া হোক৷ বিচারের আগে ক্রসফায়ারে নিরীহ মানুষও শিকারে পরিণত হতে পারেন৷ এমনটা অতীতেও হয়েছে৷ এটা অবশ্যই মানবাধিকারের লঙ্ঘন৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় সারা দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে৷ তাই আমাদের আশঙ্কা, নির্বাচনের আগে একটি ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে বিরোধীদের দমন করতে চায় সরকার৷ সেকারণেই আমরা বলছি যে, মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বিরোধীদের দমনে সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করতে পারে৷ কারণ দেশের মানুষ জানে, সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতা, এমপি থেকে শুরু করে আরো অনেকে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত৷ কিন্তু তারা গডফাদার৷ তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না৷’’
বিএনপির এই আশঙ্কার পিছনে যুক্তি আছে বলেই মনে করেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান৷ তিনি বলেন, ‘‘অতীতে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানসহ আরো অনেক অভিযান শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনরা বিরোধীদের দমনে ব্যবহার করেছে৷ এবারও তা হতে পারে৷’’
বাংলাদেশে মাদকসেবী ৭০ লাখ৷ তবে আশঙ্কার কথা হলো, এদের মধ্যে ৬০ ভাগের বয়স ১৮ বছরের নীচে৷ এ মুহূর্তে মাদক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ইয়াবা নামের এক ধরনের উত্তেজক ট্যাবলেট৷ এটা মিয়ানমার সীমান্ত থেকে পাচার হয়ে বাংলাদেশে আসে৷ এ কারণেই কক্সবাজারকে ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট মনে করা হয়৷ এ ধরনের পাচারের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতার নাম উঠে এসেছে বার বার৷
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ১৪১ জন৷ এদের মধ্যে ঢাকায় থাকেন ৪৪ জন৷ তবে তাদের কেউ আটক বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি৷
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...