মাদ্রাসা ছাত্রীকে ‘পরিকল্পিতভাবে’ পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা
৭ এপ্রিল ২০১৯ঘটনা শনিবার সকালের৷ ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় সকাল ১০টায় আলিম পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণ আগে ওই ঘটনা ঘটে৷ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সে পরীক্ষা দিতে গেলে হলে ঢোকার আগেই তার এক বন্ধবীকে তিনতলার ছাদে নির্যাতন করা হচ্ছে খবর দিয়ে সেখানে নেয়া হয়৷ ছাদে যাওয়ার পর ৪-৫জন বোরখা পড়া দুর্বৃত্ত তার শরীরের তরল দাহ্য পদার্থ (কেরোসিন) ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়৷
গুরুতর আহত ছাত্রীটিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে এসে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে৷ তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে৷ চিকিৎসকরা বলেছেন তার অবস্থা আশঙ্কাজনক৷ ডা. সামান্ত লাল সেন এই বিষয়ে বলেন, ‘‘তার চিকিৎসায় ৮ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেছি৷ আমরা তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন আছি৷ আশঙ্কায় আছি৷''
যৌন হয়রানির মামলাই কি কাল হলো?
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে আগে ধর্ষণ চেষ্টার মামলা করেছিল এই ছাত্রী৷ ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ তার কক্ষে ডেকে নিয়ে অনৈতিক প্রস্তাব দেন৷ তাকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আগাম দেয়ার কথা বলেন৷ ছাত্রীটি এর প্রতিবাদ করলে তাকে যৌন হয়রানির চেষ্টা করে৷ এই ঘটনায় ছাত্রীর মা মামলা দায়ের করলে পুলিশ অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে৷ সে এখন কারাগারে আছে৷
তবে, অধ্যক্ষ গ্রেপ্তার হওয়ার পর মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের মাঝে দু'টি গ্রুপ হয়ে যায়৷ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে৷ আরেকটি অংশ অধ্যক্ষের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করে৷ অভিযোগ আছে স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির একজন মামলা তুলে নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন৷ এছাড়া টেলিফোনেও হুমকি দেয়া হয়েছে৷
যৌন হয়রানি ও অধ্যক্ষ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ছাত্রীর বড় ভাই তাকে মাদ্রাসায় দিয়ে আসতেন৷ কিন্তু শনিবার সে নিয়ে গেলেও তাকে মাদ্রাসার ভিতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি৷
আলোচিত মাদ্রাসাটি তিন তলা৷ সেখানে সহশিক্ষা প্রচলিত রয়েছে৷ রবিবার সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মাদ্রাসাটি সুরক্ষিত৷ ঘটনার দিন গেটে পুলিশ ছিল তাই বাইরে থেকে কেউ গিয়ে ওই ছাত্রীটিকে আগুনে পুড়িয়েছে এমন আশঙ্কা কম৷ যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তারা ভিতরেই ছিল৷ তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা ছাদে গিয়ে আর কাউকে পায়নি৷ অথবা কাউকে দৌড়ে পলাতে দেখেনি৷ ঘটনাটি পূর্ব পরিকিল্পিতই মনে হচ্ছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে অধ্যক্ষ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ব্যবস্থা কমিটিতে থাকা আওয়ামী লীগের দু'টি গ্রুপ দুই দিকে অবস্থান নেয়৷ তারাই মিছিল পাল্টা মিছিল করেছিল৷ অধ্যক্ষ আগে জামায়াত করতেন৷ নানা অভিযোগে জামায়াত তাকে বহিস্কার করার পর আওয়ামী লীগের একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সহায়তায় তিনি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল পদে টিকে আছেন৷''
ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত
এদিকে, সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোজাম্মেল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখনো পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা হয়নি৷ তবে আমরা ২ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছি৷ তারা পুরুষ, তারা এর আগে ছাত্রীটিকে হুমকি দিয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এই ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত হতে পারে৷ আর এখানে বাইরে থেকে কেনো লোক আসার তেমন সুযোগ নেই৷ আমরা চেষ্টা করছি জড়িতদের চিহ্নিত এবং আটক করতে৷''
আহত হওয়ার পর অবশ্য ওই ছাত্রী এম্বুলেন্সে একটি বক্তব্য দিয়েছে৷ সেই বক্তবের অডিও ডয়চে ভেলের হাতেও এসেছে৷ তাতেই ওই ছাত্রী বলেছেন, ‘‘সকালে আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষায় অংশ নিতে মাদ্রাসায় যাই৷ মাদ্রাসায় পৌঁছলে এক ছাত্রী আমার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের উপর কেউ মারছে বলে ডেকে নেয়৷ সেখানে আরও চার-পাঁচজন মুখোশধারী ছাত্রী ছিলেন৷ তারা বলেন, প্রিন্সিপালের উপর যে অভিযোগ করেছিস তা মিথ্যা, বল৷ আমি বলি না, আমি যা বলেছি সব সত্যি৷ তারা বলে, তোকে এখনই মেরে ফেলবো৷ আমরা তোর সব খবর নিছি৷
অডিও রেকর্ডে ও শিক্ষার্থী আরো বলেন, ‘‘আমি বলি, আমি সব সত্য বলেছি৷ আমি শিক্ষকদের সম্মান করি, কিন্তু যে শিক্ষক আমার গায়ে হাত দিয়েছে আমি তার প্রতিবাদ করেছি৷ সঙ্গে সঙ্গে তারা আমার হাত-পা চেপে ধরে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়৷''
উল্লেখ্য, ঢাকায় হাসপাতালে ওই ছাত্রীর বাবা-মা এবং দুই ভাই রয়েছেন৷ তবে তারা মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত যে তাদের সঙ্গে বারবার চেষ্টা করেও বিস্তারিত কথা বলা যায়নি৷ তার ছোটভাই রাশেদুল হাসান রায়হান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার অপার অবস্থা খুবই খারাপ, আশঙ্কাজনক৷ তার শেষ পর্যন্ত কি হয় জানিনা৷''